শব্দ বদলালেই বদলে যাবে জীবন
“ভাষাই আমাদের আচরণকে নির্দিষ্ট আকার দান করে। আমাদের ব্যবহার করা প্রতিটি শব্দই আমাদের ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। সঠিকভাবে বলা সঠিক শব্দটি জীবনে ভালোবাসা, অর্থ ও সম্মান নিয়ে আসতে পারে। একই ভাবে ভুল শব্দ, এমনকি ভুল ভঙ্গিতে বলা সঠিক শব্দও কোনো দেশে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে পারে। একটা সমৃদ্ধ জীবন চাইলে, আমাদের উচিত অতি অবশ্যই আমাদের ব্যবহার করা শব্দগুলোর প্রতি মনোযোগী হওয়া। – ডাক্তার এন্ড্রু নিউবার্গ, ওয়ার্ডস ক্যান চেঞ্জ ইওর ব্রেইন।”
মানবজাতির ইতিহাস জুড়ে দেখা যায় যে সব মহান নেতাই শব্দের এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের একত্রিত করেছিলেন। উইনস্টন চার্চিলের ‘সবচেয়ে সুন্দর ঘন্টা’ থেকে শুরু করে মার্টিন লুথার কিং-এর ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে’- সবখানেই এর সত্যতা মেলে। আমরা জানি যে বিশ্বাস গঠিত হয় শব্দ দিয়ে – এবং শব্দ দিয়েই তাদের পরিবর্তন সম্ভব। কিন্তু আমাদের এই শব্দ ব্যবহারের ক্ষমতা ব্যবহার করে আমরা কিভাবে একটি উন্নত জীবন পাবো?
শব্দ আমাদের নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ ও অন্যদের সাথে অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করার ক্ষমতা দেয়। কিন্তু কখনো কি আপনার মনে হয়েছে যে- আপনার বাছাই করা দুর্বল শব্দগুলোই কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাজে পরিস্থিতির জন্য দায়ী ছিল?
গত ৪০ বছরে প্রায় পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষের সাথে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। এবং সরাসরি দেখার সুযোগ হয়েছে কিভাবে শুধুমাত্র একটি শব্দের পরিবর্তন কারো অনুভূতি ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এবং আমি এটা আপনাকে খুব সহজেই বুঝিয়ে দিতে পারি আপনার অভ্যাসগত শব্দতালিকা পরিবর্তনের মাধ্যমে – আবেগ প্রকাশের জন্য আপনি যে শব্দগুলো ব্যবহার করেন। এর ফলে আপনি তাৎক্ষণিকভাবে আপনার চিন্তা, অনুভুতি ও জীবনকে পরিবর্তন করতে পারবেন। এটাকে আমি বলি রূপান্তরমূলক শব্দতালিকা – একটা সুন্দর জীবনের জন্য সচেতনভাবে শব্দ ব্যবহার করা।
কম্পটনের এনসাইক্লোপিডিয়া অনুসারে ইংরেজি ভাষাতে প্রায় পাঁচ লাখ শব্দ আছে। অথচ একজন সাধারণ মানুষ গড়ে প্রায় দুই হাজার শব্দ জানে- যা পুরো ভাষার ০.৫%। আর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত শব্দের সংখ্যা? চোখ কপালে তুলবেন না। সংখ্যাটা সাধারনত ২০০-৩০০ শব্দ। যা হোক, এই পাঁচ লাখ শব্দের মধ্যে কমবেশি ৩০০০ শব্দ অনুভূতি প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। এবং যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই নেতিবাচক আবেগের জন্য বরাদ্দ।
নিজেদের অনুভূতি ও ভাব প্রকাশের জন্য এত চমৎকার একটা ব্যাপার থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষের শব্দতালিকা এত সংক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ কি? এর একটা কারণ হচ্ছে কথা বোঝার জন্য কম শব্দ জানাটা মানুষকে কোনো অসুবিধায় ফেলে না। আমাদের মস্তিষ্ক খুবই উচ্চগতিসম্পন্ন। এটা আমাদের কোন কিছুর অর্থ বুঝতে ও যত দ্রুত সম্ভব সেই ব্যাপারে সাড়া দিতে চেষ্টা করে। যে কারণে আমরা একই শব্দ বারবার এবং বারবার ব্যবহার করতে থাকি, যা আমাদের অনুভূতির প্রকাশ সীমাবদ্ধ করে ফেলে।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আমি সারা পৃথিবীজোড়া মানুষের সাথে সরাসরি কাজ করেছি। আমি তাদেরকে খুব সহজ একটা কাজ দিতাম- সপ্তাহে অন্তত একবার বোধ করেন এমন অনুভূতিগুলোর একটা তালিকা করুন। তারা সাধারণত ৫ থেকে ১০ মিনিট সময় নিতো। হাস্যকর শোনালেও সত্যি যে শ্রোতাদের সংখ্যা ২০০০ই হোক কিংবা ৩০০০০, শতকরা ৯০ জনই গড়ে ডজনখানেক শব্দ লিখতো। যার অর্ধেকের চেয়ে বেশির ভাগইহতো নেতিবাচক। তার মানে দাঁড়াচ্ছে – আমাদের আবেগ সংক্রান্ত ৩০০০ শব্দের মাঝে অধিকাংশ মানুষই ৫-৬টি ভালো আবেগ বোধ করে, আর খারাপ আবেগগুলো বার বার ফিরে আসে। আমরা সাধারণত আনন্দিত ও উত্তেজিত হই, কিন্তু তারপরই হই রাগান্বিত, হতাশ, দুঃখী, এমনকি বিষণ্ন। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক – নিজের অনুভূতি প্রকাশের জন্য আপনার ব্যবহার করা শব্দগুলো নিয়ে কখনো সচেতনভাবে ভেবে দেখেছেন? আপনার কি মনে হয় আমরা যখন কোন নেতিবাচক অনুভূতির মুখোমুখি হই, তখন আসলে আমরা ওই অনুভূতিগুলোর উপরে সাঁটানো শব্দগুলোর দ্বারাই আক্রান্ত হই?
সমস্যা হচ্ছে আবেগ প্রকাশের জন্য আমরা সবসময় সচেতনভাবে শব্দ ব্যবহার করিনা। যেকোন বাজে অভিজ্ঞতার জন্যই আমাদের নিজ নিজ প্রচলিত শব্দ আছে। এবং ঝামেলা হচ্ছে- আমাদের অভিজ্ঞতার সাথে আমরা যেই শব্দগুলো যুক্ত করি সেগুলোই মূলত আমাদের অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত হয়। শব্দ আমাদের শরীরে সরাসরি প্রভাব ফেলে। যে মুহূর্তে আপনি ‘বিধ্বস্ত’ শব্দটা ব্যবহার করবেন, এটা আপনার শরীরে ‘আমি কিছুটা হতাশ’র চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম প্রভাব ফেলবে।
অন্য লোকেরা যখন আমাদের সাথে কথা বলে তখন সহজেই এটা লক্ষ্য করা যায়। ধরুন কেউ একজন আপনাকে বললো যে, ‘আপনি বোধহয় ভুল করেছেন’, বনাম ‘আমার মনে হয় আপনি ভুল’, বনাম ‘আপনি মিথ্যা বলছেন’, আপনার প্রতিবার ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া হবে।এই একই ব্যাপার আমাদের সাথেও ঘটে যখন আমরা নিজেদের সাথে কথা বলি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো – আমরা এর প্রভাব নিয়ে মোটেও সচেতন না।
প্রায় দেড় দশক আগে এক উত্তপ্ত আলোচনার পর শব্দের এই শক্তির ব্যাপারটা নিয়ে আমি প্রথমবারের মতো সচেতন হই। আমি তখন আমার দুই বিজনেস পার্টনারের সাথে আলোচনা বলছিলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অন্য পক্ষ আমার কথা ভালোভাবে নেয়নি।
ব্যাপারটা বেশ হতাশাজনক ছিল। পরে আমি আমার অন্য আরো দুইজন পার্টনারের সাথে বসলাম ও লক্ষ্য করলাম যে আগের আলোচনাটি নিয়ে আমাদের তিনজনের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা। আমি ছিলাম হতাশ ও উত্তেজিত। আমার আরেক পার্টনার ছিল ক্রুদ্ধ এবং সে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো যে তার মনে হচ্ছিল ‘ওরা যেন তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে রেখেছে’। ততক্ষণে তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। নিজের রাগ সত্ত্বেও আমি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। খুব বেশি সুবিধা হলো না। কিন্তু লক্ষ্য করলাম যে আমার অন্য আরেক পার্টনার ব্যাপারটা নিয়ে মোটেও বিচলিত না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি একেবারেই স্বাভাবিক আছো। রাগ লাগছে না তোমার?’ সে বলল, ‘খুব একটা না। আমার একটু বিরক্ত লাগছে।’ আমি অবাক হলাম, ‘বিরক্ত! তুমি কি বুঝতে পারছো না এরা কি করলো?’ সে বলল, ‘অবশ্যই বুঝেছি। ব্যাপারটা আমাকে বেশ আহত করেছে।’ আমি তার কথার প্রতিধ্বনি করলাম, ‘আহত! আহত বলতে তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছো?’ সে উত্তর করলো, ‘আসলে, আমার মনে হয় এটা নিয়ে খুব বেশি বিপর্যস্ত হওয়াটা মূল্যহীন।’
ব্যাপারটা আমাকে বেশ ভাবালো। কিভাবে একই ঘটনা নিয়ে আমাদের তিনজনের তিন রকমের প্রতিক্রিয়া হতে পারে- প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ বনাম রাগান্বিত বনাম বিরক্ত। এবং কিভাবে একই ঘটনা নিয়ে আমাদের তিন রকম অভিজ্ঞতা হলো। এটা কিভাবে হতে পারে যে আমি ছিলাম ‘হতাশ‘ ও ‘উত্তেজিত‘, একজন ছিল ‘প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ‘ ও ‘রাগান্বিত’, এবং অপরজন ‘বিরক্ত‘ ও ‘কিছুটা আহত‘? এমনকি ‘বিরক্ত’ শব্দটা আমাকে ‘কিছুটা আহত’ও করলো। ওরা আমাদের সাথে যা করলো সেই তুলনায় এটা একটা হাস্যকর শব্দ।
এটা কি সম্ভব যে যেসব শব্দ আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা বোঝাতে ব্যবহার করি, সেগুলিই আমাদের অভিজ্ঞতা হয়? শব্দ কি আমাদের শরীরে প্রভাব ফেলে? পরের কয়েক সপ্তাহে আমি আবিষ্কার করলাম যে প্রত্যেকটি মানুষের ভাষার ভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন। এবং এটা তাদের আবেগে সরাসরি প্রভাব রাখে।
তাই আমি নিজে নিজে ১০ দিনের একটা চ্যালেঞ্জ দিলাম। আমার কাজ হলো এই কয়দিনে মুখোমুখি হওয়া আমার সবচেয়ে খারাপ অনুভূতিগুলোর শনাক্ত করা এবং তাদের জন্য একটা করে নতুন শব্দ খুঁজে বের করা। যে শব্দ সেই অনুভুতিকে যথেষ্ট ভোঁতা ও হাস্যকর করে তুলবে। এটা আমার নিজের চিন্তা ও অনুভূতির প্যাটার্নকে আঘাত করবে।
আমি আমার প্রথম সুযোগ পেলাম বেশ কিছু বিলম্বিত বিমান ফ্লাইটের পর। রাত দুইটায় আমি আমার হোটেলে প্রবেশ করলাম, যখন কিনা আমি জানি সকাল আটটায় আমাকে আবার বক্তৃতা দেয়ার জন্য উঠতে হবে। এবং ১০ মিনিট ধরে হোটেলের রিসিপশনে অপেক্ষা করতে লাগলাম। হোটেলের লোকটি এত ধীরে ধীরে কম্পিউটারে আমার নাম খুঁজতে লাগলো যে তা যেকোনো শামুককেও অধৈর্য করে ছাড়বে। বুঝতে পারছিলাম আমার ভেতর বিরক্তি জড়ো হচ্ছে যা অচিরেই রাগে রূপ নেবে। আমি তাকে বললাম, ‘দেখুন আমি জানি এটা ঠিক আপনার দোষ নয়। কিন্তু আমি খুবই ক্লান্ত। আপনি আমাকে যেকোন একটি রুম দিন। কারণ এটা আমাকে “কিছুটা বিরক্ত” করছে।’ ‘বিরক্ত’ শব্দটা আমার কথার পুরো ভঙ্গিকেই পাল্টে দিয়ে পরিস্থিতিটাকে হালকা করে দিল। হোটেলের লোকটা আমার দিকে মিটমিট করে তাকিয়ে হাসিতে ভেঙ্গে পড়লো। আমিও পাল্টা হাসি দিলাম। আমার প্যাটার্ন ভেঙ্গে গেছে। হাস্যকর ও সরল শোনালেও, আমার শব্দতালিকায় শুধুমাত্র এই একটিমাত্র শব্দের প্রবেশই আমার চিন্তার ভঙ্গিটি পাল্টে দিল। এটা অনেকটা তুমি ‘ঠিক না’ বনাম তুমি ‘ভুল’-এর মত। আমার ভেতরের রাগ শান্ত হয়ে এলো।
এটা কি আসলেই এত সোজা? শুধু নিজেদের অনুভূতির ব্যাপারে নিজেদের স্বভাবগত শব্দ পরিবর্তনের ফলেই আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে ফেলতে পারি? আমার দশদিন রূপান্তরিত হয়েছিল মাসে এবং এটা ছিল একটা জীবন বদলানো সিদ্ধান্ত। এমন না যে জীবনে রাগান্বিত বা উত্তেজিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেটা যদি স্বভাবগত প্রতিক্রিয়ার বদলে নিজের সচেতনভাবে বাছাই হয়, তাহলেই কি সবচেয়ে ভালো হয় না?
আমি যা খুঁজে পেয়েছি তা হলো:যদি নিজের জীবন বদলাতে চান, নিজের সিদ্ধান্তগুলোকে জোরালো করতে চান, তবে আবেগের ভঙ্গিটি পরিবর্তন হতে পারে একটি চমৎকার ব্যাপার। এবং এটা অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে দ্রুত পরিবর্তন করার একটি উপাদান হলো – কেমন বোধ করছেন, তা সম্পর্কে সচেতনভাবে শব্দ বাছাই করা।
আমি একে রূপান্তরমূলক শব্দতালিকা বলে থাকি। কারণ এটা আপনাকে নিজের জীবনের বাজে অনুভূতিগুলো পরিবর্তনের ক্ষমতা দেয়। এবং তাদের তিক্ততা কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। এমনকি এটা ইতিবাচক অভিজ্ঞতা পেতে ও তাকে একটা অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
এটাকে কি ব্যাকরণের শব্দবিদ্যার মতো মনে হচ্ছে? শব্দ আর কিইবা পার্থক্য তৈরি করতে পারে? কিন্তু আপনি যদি এটা নিজের জীবনে প্রয়োগ করেন, সত্যটা জানতে পারবেন। যদি আপনি সকল নেতিবাচক অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তাহলে আপনার জীবনটা কেমন হবে? কিংবা যদি জীবনের সব ভালো অভিজ্ঞতা আরো অর্থবহ করে তোলা যায়?
www.tonyrobbins.com-এ পূর্ব প্রকাশিত।
মন্তব্য করুন