ইসলাম: একটি বিশ্বসভ্যতা

Image Source: www.quora.com
ইসলামী সভ্যতার সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ
একটা বিশ্বধর্ম হয়ে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়াটা ইসলামের জন্য যেন পূর্ব নির্ধারিতই ছিল। মুসলিম খেলাফতের শুরুর দিকে প্রথমে আরব, পরে ফার্সি এবং সবশেষে তুর্কিরা ইসলামী সভ্যতার গোড়াপত্তন করে। পরে তেরশ শতকে আফ্রিকা ও ভারত ইসলামী সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এবং কাছাকাছি সময়ে মালয়-ইন্দো অঞ্চলেও মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন কিনা চীনে চীনা মুসলমানরাও মাথা তুলতে শুরু করেছে।
ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত। ঠিক এই কারণেই ইসলামী সভ্যতা একটা ঐক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত যা যেকোন ধরনের জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে। তাই আরব, ফার্সি, তুর্কি, আফ্রিকান, ভারতীয়, চীনা, মালয় প্রভৃতি বড় জাতিদের সাথে অনেক ছোট ছোট সম্প্রদায়ও ইসলামী সভ্যতার বিকাশে অবদান রাখে। তাছাড়া ইসলাম পূর্বের সভ্যতাগুলো থেকে শেখার ব্যাপারে কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করে না। বরং তাদের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে নিজের মধ্যে ধারণ করে, যদি না সেগুলো ইসলামের মূল আদর্শের বিরোধী হয়। এভাবে এতে যুক্ত হওয়া ছোট-বড় সব জাতিই নিজের নিজের মতো করে এই বিশাল ইসলামী সভ্যতায় অবদান রেখেছে।
এই বিশ্বসভ্যতা তার মাঝে আসা মানুষের মন ও চিন্তায় প্রভাব রাখার ব্যাপারেও যথেষ্ট সফল। ইসলামের কারণেই যাযাবর আরবদের হাতে শোভা পেয়েছিলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের মশাল। এমনকি ফার্সিরা, যারা কিনা ইসলামের আগেই একটা সমৃদ্ধ সভ্যতার সূচনা করেছিল, তারাও আগের চেয়ে আরো জোরালোভাবে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করতে লাগলো। তুর্কি ও অন্যান্য জাতিদের নিয়েও একই রকম বলা যায়। প্রায় আটশ বছর ধরে আরবী ছিল জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রধান ভাষা। ইসলামের শুরুর দিকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ভিন্ন ভিন্ন মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাও এই সভ্যতার বিকাশের একটা অন্যতম কারণ। এমনকি শুধুমাত্র আধুনিক সময়ের গোড়ার দিকে এসে বাইরের শক্তির প্রভাব ও মুসলমানদের নিজেদের বিশ্বাসের দুর্বলতা- ইসলামের ঐতিহ্যকে বাধাগ্রস্ত করতে পেরেছে। এবং এখন মুসলমানরা তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার সাথে সাথে একটি নতুন আরম্ভও ইসলামী বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে।
ইসলামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: চার খলিফা

Image Source: www.sutori.com
নবী মুহম্মদ (স)- এর মৃত্যুর পর খলিফা হন তার বন্ধু ও ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম পুরুষ আবু বকর (রা)। তাঁর শাসনকাল ছিল দুই বছর। তাঁর পর খলিফা হন উমর (রা), যার দশ বছরের শাসনকালে পারস্য, সিরিয়া ও মিশর জয়ের পর ব্যাপকভাবে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি পায়ে হেঁটে মুসলিম বাহিনীর পেছনে জেরুজালেম প্রবেশ করেন ও খ্রিস্টানদের ক্ষতি না করার নির্দেশ দেন। উমরই সর্বপ্রথম গণকোষাগার ও চমৎকার একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামী শাসন ব্যবস্থার অনেক কিছুই তাঁর হাত ধরে প্রথম শুরু হয়।
উমরের পর ক্ষমতায় আসেন উসমান (রা)। তাঁর বারো বছরের শাসনকালে ইসলামে সম্প্রসারণ চলতে থাকে। তিনি প্রথম কুরআনকে লিপিবদ্ধ করেন ও ইসলামী সাম্রাজ্যের চার কোনায় কোণায় পাঠান। তারপরে ক্ষমতায় আসেন বাকপটু আলী (রা), যিনি তার সাহসের জন্যও সুপরিচিত। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে মুসলমানদের হৃদয়ে একটা বিশেষ শ্রদ্ধা ও সম্মান দখল করে রাখা চার খলিফার শাসনের অবসান ঘটে।
খিলাফত
৬৬১ সালে উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয় যা প্রায় একশ বছর ক্ষমতায় ছিল। এ সময়ে দামেস্ক ইসলামী বিশ্বের রাজধানী হয়। এবং উত্তর আফ্রিকার মাধ্যমে পশ্চিমে স্পেন ও ফ্রান্স থেকে শুরু করে পূর্বে মধ্য এশিয়া ও সিন্ধু পর্যন্ত ইসলামী সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়। এ সময় নব গঠিত ইসলামী বিশ্বে অনেক নতুন সামাজিক ও আইনগত প্রতিষ্ঠানের প্রবর্তন করা হয়।
উমাইয়াদের পর ক্ষমতায় আসে আব্বাসীয়রা। তারা বাগদাদকে রাজধানী করে, যা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্ষমতার এক অতুলনীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়।
তারা প্রায় ৫০০ বছর শাসন করে। যদিও তাদের ক্ষমতা ক্রমেই কমে আসে এবং বিভিন্ন রাজপুত্র ও সুলতানরাই সামরিক ক্ষমতার অধিকারী হয়। ১২৫৮ সালে মঙ্গোলীয় নেতা হালাকু বাগদাদ দখল করলে আব্বাসীয় খিলাফতের পতন ঘটে। এসময় শহরের অনেক কিছু ধ্বংস করা হয়, যার মধ্যে বেশকিছু সমৃদ্ধ লাইব্রেরীও রয়েছে।
আব্বাসীয়রা যখন বাগদাদ শাসন করছিলেন ফাতেমীয়, আইয়ুবীয় ও মামলুক শাসকেরা মিশর, সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের ক্ষমতায় ছিলেন। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল পবিত্র নগরী জেরুজালেমের অধিকার নিয়ে ইসলাম ও পশ্চিমের মধ্যকার সংঘাত- পোপ ঘোষিত ও বিভিন্ন ইউরোপীয় রাজা পরিচালিত বেশ কিছু ক্রুসেড। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইউরোপীয়রা সাফল্যও পায় এবং সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের কিছু অংশে স্থানীয় ইউরোপীয় শাসনের সূচনা করে। যদিও ১১৮৭ সালে চৌকস মুসলমান নেতা সালাউদ্দিন ক্রুসেডারদের হারিয়ে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন।
উত্তর আফ্রিকা ও স্পেন

Image Source: www.timemaps.com
আব্বাসীয়রা যখন দামেস্ক দখল করে, একজন উমাইয়া রাজপুত্র পালিয়ে স্পেনে যায় ও সেখানে উমাইয়া শাসনের সূচনা করে। এভাবেই স্পেনে ইসলামী স্বর্ণযুগের শুরু হয়। কর্দোবা রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অচিরেই ইউরোপের অন্যতম সমৃদ্ধ নগরীতে পরিণত হয়। স্থানীয় শাসকদের দ্বারা পরাজিত হওয়ার আগ পর্যন্ত উমাইয়ারা প্রায় দুই শতক জুড়ে স্পেন শাসন করে।
এদিকে উত্তর আফ্রিকায় বিভিন্ন স্থানীয় রাজবংশ ক্ষমতা দখল করে রাখে, যতক্ষণ পর্যন্ত না দুটি ক্ষমতাশালী বার্বার রাজবংশ ১২শ ও ১৩শ শতকে উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনকে একীভূত করতে সক্ষম হয়। তাদের পরে এই ভূখণ্ড আবারো স্থানীয় শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়। আর ১৪৯২ সালে গ্রানাডাতে শেষ মুসলিম রাজবংশ পরাজিত হওয়ার মাধ্যমে স্পেনে প্রায় আটশ বছরের মুসলমান শাসনের পতন ঘটে।
মঙ্গোল আক্রমণের পর ইসলামের ইতিহাস
মঙ্গোলরা ইসলামের পূর্বাঞ্চলীয় ভূখণ্ড আক্রমণ করে এবং সিনাই মরুভূমি থেকে ভারত পর্যন্ত প্রায় এক শতক শাসন করে। কিন্তু তারা অচিরেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ইলখানাত নামে পরিচিত হয়। পরে তারা তৈমুর ও তার বংশধরদের দ্বারা পরাজিত হয়, যারা সমরখন্দকে রাজধানী করে ১৩৬৯ থেকে ১৫০০ সাল পর্যন্ত শাসন করে। তৈমুরের এই উত্থান অটোমান সাম্রাজ্যের বিস্তৃতিকে কিছুটা বিলম্বিত করলেও খুব শীঘ্রই অটোমানরা ইসলামী বিশ্বের প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হয়।

Image Source: www.pinterest.co.uk
তেমন কোনো সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও তুর্কিরা পুরো আনাতোলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন অংশ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। ১৪৫৩ সালে ‘বিজয়ী’ মুহম্মদ কনস্টান্টিনোপল দখল করে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। অটোমানরা পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ এবং প্রায় সমগ্র আরব বিশ্ব জয় করে নেয়। তারা রাজা সুলাইমানের হাত ধরে ক্ষমতার শিখরে ওঠে, যার সৈন্যবাহিনী হাঙ্গেরি ও অস্ট্রিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। ১৭শ শতকের পর থেকে পশ্চিম ইউরোপীয় শক্তি ও পরে রাশিয়ার প্রভাবে অটোমানরা দুর্বল হতে থাকে। কিন্তু তার প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তারা পশ্চিমা শক্তির হাতে পরাজিত হয়। এর পরপরই কামাল আতাতুর্ক ক্ষমতায় আসে। এভাবে ১৯২৪ সালে প্রায় ছয় শতকের অটোমান শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। অটোমানরা যখন তাদের সাম্রাজ্যের পশ্চিম সীমান্ত নিয়ে উদ্বিগ্ন, তাদের পূর্ব দিকে পারস্যে ১৫০২ সালে সাফাভি নামের একটি নতুন রাজবংশ ক্ষমতায় আসে। সাফাভিরা একটি শক্তিশালী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে যা প্রায় দুইশ বছর টিকে থাকে।এবং এটি শিল্পচর্চার জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। তাদের রাজধানী ইস্পাহান নীল টাইলসের মসজিদ ও চমৎকার নকশা বাড়িঘরের জন্য সুপরিচিত ছিল। ১৭৩৬ সালে আফগানদের আক্রমণে সাফাভিদের পতন ঘটে। পারস্যে অরাজকতা চলতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না নাদির শাহ গোটা দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে, এমন কি ভারত জয় করে। কিন্তু তার রাজবংশের আয়ু খুব বেশি দিন ছিল না। শীঘ্রই জ্যান্ড রাজবংশ ক্ষমতা নেয় ও ১৭৭৯ সালে কাজারদের দ্বারা পরাজিত হয়। কাজাররা তেহেরানকে তাদের রাজধানী বানিয়ে ১৯২১ সাল পর্যন্ত পাহলভীদের কাছে পরাজিত হওয়ার আগ পর্যন্ত শাসন করে।

Image Source: www.pinterest.co.uk
অন্যদিকে সিন্ধু নদের পূর্ব অববাহিকা দিয়ে ভারতে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রবেশ করে। ১৩শ শতকের শুরুর দিক থেকে মুসলমানরা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করে। ১৫২৬ সালে সম্রাট বাবর ভারতের অধিকাংশ অঞ্চল জয় করে নেন। তিনি ভারতের বিখ্যাত মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। এই বংশেই আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান প্রমুখ বিখ্যাত শাসকেরা জন্মগ্রহণ করেন। উপমহাদেশে ব্রিটিশ শক্তির বিকাশ লাভের সাথে সাথে ১৮৫৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এর সমাপ্তি ঘটে। আরো পূর্ব দিকে মালয় দ্বীপপুঞ্জে ১২শ শতকে উত্তর সুমাত্রায় ইসলাম প্রসার লাভ করে। শীঘ্রই জাভা, সুমাত্রা ও মালয়েশিয়ায় মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইসলামী সময়ের শুরুতেই পূর্ব আফ্রিকাতে ইসলাম প্রবেশ করলেও বেশ কিছু সময় এটা উপকূলেই সীমাবদ্ধ ছিল। শুধুমাত্র সুদান ও সোমালি অঞ্চল ধীরে ধীরে আরব ও ইসলামের অধিকারে আসে। পশ্চিম আফ্রিকা উত্তর আফ্রিকার ব্যবসায়ী যারা কিনা উটের ক্যারাভান নিয়ে সাহারা মরুভূমির দক্ষিনে অভিযানে বের হতো, তাদের দ্বারা ইসলামের উপস্থিতি টের পেতে থাকে। ১৪শ শতকে মালি, টিম্বুকতু এবং হারার প্রভৃতি জায়গায় মুসলমান সুলতানরা ক্ষমতায় আসে। ধীরে ধীরে ইসলাম মহাদেশের আরো ভেতরে ও দক্ষিনে প্রবেশ করে। এসব অঞ্চলের ইতিহাসে বেশ কিছু শক্ত চরিত্রের দেখা মেলে যারা কিনা ইউরোপের প্রভাবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। এই অঞ্চলে ইসলামীকরণের প্রক্রিয়া ঔপনিবেশিক আমলেও থেমে থাকেনি এবং এখন পর্যন্ত চলমান। যার ফলশ্রুতিতে এখনকার অধিকাংশ আফ্রিকানই মুসলমান, যাদের আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল;এমনকি স্বয়ং ইসলামের সমান দীর্ঘ ইতিহাসেরও ঐতিহ্য আছে।
www.islamicity.com সাইটে প্রকাশিত আর্টিকেলের ছায়া অবলম্বনে লেখা।
মন্তব্য করুন