সফল ব্যক্তিরা যে ৭টি মানসিক অনুশীলন করে থাকেন

Share

আমি ভাগ্যবান কারণ সম্প্রতি আমি একটি অনুষ্ঠানে মানসিক অবস্থার বিশ্লেষক ট্রেভর মোওয়াল্ডের পাশাপাশি বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম এবং বক্তব্যের বিষয়বস্তু ছিল তরুণ উদ্যোক্তা এবং তাদের অনন্য চিন্তা ধারা। অনন্য কথাটার অনেক অর্থ থাকলেও আমার কাছে অনন্য মানে পেশাগত খেলা বা বিশেষ কোন পেশার জন্য সংরক্ষিত কোন ব্যক্তি বিশেষ নয়। একজন ব্যক্তি অনন্যতাকে কিভাবে দেখছে তার উপরই নির্ভর তার অসাধারণ হয়ে উঠা।

যখন আমি একজন দলনেতা এবং তার অধীনস্থ ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি তখন আমি অনেকটা এই রকমের মানসিক অবস্থা দেখতে পাই তাদের মাঝে। কাজের ধরন অনুযায়ী ও মানসিক দৃঢ়তার ভিত্তিত সকলকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় –

১. সৈনিক অথবা খেলোয়াড়, যাদের মানসিকভাবে বলিষ্ঠ হওয়াটা খুব প্রয়োজন।

২. বাকি সবাই।

যদি আপনি মিলিটারি সেক্টরে কাজ না করে থাকেন বা প্রতিদ্বন্দী মনোভাবসম্পন্ন না হন তাহলে শুধু মানসিক বলিষ্ঠতার প্রয়োজনীয়তাই নয় বরং এর মুল্য বুঝতেও বেগ পেতে হতে পারে।

অ্যাথলেটিক ইভেন্টগুলো খুব স্বল্প সময়ের হয়ে থাকে। যদি আপনি অলিম্পিক স্প্রিন্টার হয়ে থাকেন তাহলে খেলা প্রদর্শনের জন্য ১০ সেকেন্ডের বেশী সময় পাবেন না, আবার যদি আপনি এনএফএল খেলোয়াড় হয়ে থাকেন তাহলে ৬০ মিনিট সময় পাবেন।কিন্তু আমেরিকার কর্পোরেট জগতে প্রতিদিন ৮ ঘন্টা করে দক্ষতার সাথে কাজ করে যেতে হয়। আর যদি আপনি একজন তরুন উদ্যোক্তা হয়ে থাকেন তাহলে আপনার জন্য কর্মদিবসের সময়সীমাটা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে।

এখানে মূল বিষয় হল, আপনি যে ক্ষেত্রেই কাজ করুন না কেন আপনাকে অবশ্যই প্রচুর কাজের চাপের মধ্যে থেকেও সঠিকভাবে চিন্তা করে ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে সমস্যা সমাধান করতে হবে এবং টিকে থাকতে হবে। নেতৃত্ব প্রদানের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বর্তমানে অনেক ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে এবং এই প্রশিক্ষণগুলোর মূল উদ্দেশ্য থাকে ব্যক্তিভেদে ভাল কথোপকথনের দক্ষতা, শোনার দক্ষতা ও সকলের সামনে কথা বলার দক্ষতা নৈপুণ্যতাকে শাণিত করা।যদিও এই দক্ষতাসমূহ পেশাদারী দায়িত্ব পালনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তারপরও দেখা যায় কঠিন অবস্থায় যখন কেউ মধ্যস্থতা করছে, শুনছে বা কথা বলছে তখন তার মধ্যে ফোকাস করার ক্ষমতা, স্ব পরিচালনা এবং অটলভাবে লেগে থাকার উদ্যমের কমতি লক্ষ্য করা যায়।

প্রশিক্ষণ দেওয়ার পূর্বে আমি প্রায় ১৩ বছর নেভী সিল হিসেবে কর্মরত ছিলাম। এখানে কাজ করার প্রাক্কালে আমার পাওয়া সবথেকে বড় শিক্ষাটি ছিল যে, প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে নির্বাচন পর্যন্ত কিভাবে ধাপে ধাপে মানসিক কার্য সম্পাদন করতে হয়। প্রত্যেককেই লক্ষ্য নির্ধারনে সমর্থ হতে হবে। প্রচুর কাজের চাপেও সঠিকভাবে চিন্তা করার দক্ষতা থাকতে হবে। নিজেকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সমর্থ হতে হবে। বিশেষত ৭ টি বিষয় রয়েছে যা একজন ব্যক্তিকে মানসিকভাবে বলিষ্ঠ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হল:

লক্ষ্য নির্ধারণ

যদি আপনি আপনার কাজ এবং গন্তব্য সম্পর্কে ওয়াকেবহাল থাকেন, তাহলে আপনার অবশ্যই একটি লক্ষ্য থাকবে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আপনি যদি একই সাথে একই সময় সকল বিষয়কে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন, তাহলে আপনার জন্য লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাই সঠিকভাবে পরিকল্পনা করুন এবং সেই অনুযায়ী আপনাকে এগোতে হবে আপনার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য।

নিজের সাথে কথা বলুন

আপনি যখন কারো সাথে কথা বলার প্রস্তুতি নেন হোক সে বিশাল জনতার সামনে অথবা গুটি কয়েক ব্যক্তির সামনে, তখন কিছু কথা আপনার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে যেমন “আমি খুব বাজে একজন উপস্থাপক” অথবা “আমি আসলে এই কাজটা করতে চাই না”। নিজের মনে এমন নেতিবাচক ভাবনার উদয় হয় তখনই যখন আপনার মস্তিষ্ক সঠিকভাবে অবগত নয় যে আপনি আসলে ঠিক কি করতে যাচ্ছেন বা চাচ্ছেন। তাই নিজের সাথে কথা বলুন এবং অবশ্যই কিছু ইতিবাচক কথা বলুন। এ ব্যাপারে ট্রেভর বলেছেন, উচ্চস্বরে নিজের সাথে কথা বলুন যাতে নিজের কথাগুলো নিজের কানে প্রবেশ করে।

কল্পনাশক্তি

কল্পনাশক্তি আপনার মানসিক শক্তিকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন বাস্কেটবল দলের উপর একটি গবেষণা করা হয়।

  • প্রথম দলটি প্রত্যেকদিন বল ছোঁড়ার অভ্যাস করতে থাকে এবং এভাবে করে টানা ২০ দিন অনুশীলন করে। তাদের উন্নতি হয়েছিল শতকরা ২৪ ভাগ।
  • দ্বিতীয় দলটি শুধুমাত্র ১ম দিন এবং ২০তম দিনে বল ছোঁড়ার অনুশীলন করেছিল। তাদের আদৌ কোন উন্নতি হয় নি।
  • তৃতীয় দলটিও শুধুমাত্র ১ম দিন এবং ২০তম দিনে বল ছোঁড়ার অনুশীলন করেছিল কিন্তু এর মাঝের দিনগুলোতে তারা প্রতিদিন মনে মনে বল ছোঁড়ার কল্পনা করত। তাদের উন্নতি হয়েছিল শতকরা ২৩ ভাগ।

আপনি আপনার পরবর্তী মিটিং এ কিভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে চান, আসন্ন ইন্টারভিউ এ আপনি কতটা কৃতকার্য হতে চান অথবা আপনার সহকর্মীর সাথে কিছু জটিল বিষয়ে কিভাবে কথাগুলোকে উপস্থাপন করতে চান তা অনেকাংশে নির্ভর করে যে আপনি এই অবস্থাগুলোকে কিভাবে কল্পনা করছেন। মনে রাখবেন যে আপনি সেই উত্তরগুলোই দিয়ে থাকেন, যে দৃশ্যপটগুলো আপনি আপনার মস্তিষ্কে আগে থেকেই ধারণ করে রেখেছেন। সুতরাং, সঠিক কল্পনা করার ব্যাপারে অবশ্যই সচেষ্ট থাকতে হবে।কি ভুল হতে পারে বা আপনার সাথে কি কি নেতিবাচক ঘটনা ঘটতে পারে তা না ভেবে বরং কত সুন্দর এবং সুষ্ঠুভাবে আপনি কাজটি সমাধান করতে পারেন সেই বিষয়ে কল্পনা করা উচিত।

লক্ষ্য নিয়ন্ত্রণ

ইঁদুর দৌড়ের এই প্রতিযোগিতায় অনেকে লক্ষ্য নিয়ন্ত্রণের সমস্যায় ভুগে থাকেন। লক্ষ্য নিয়ন্ত্রণ এর অর্থ হচ্ছে আপনি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করবেন এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাবেন।লক্ষ্য নিয়ন্ত্রণে দুইটি কাজ অপরিহার্য –

১. এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যাতে করে কোন ভাবেই যেন আপনি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে না পড়েন।

২. অনেকগুলো কাজ একসাথে না করে বরং একটি একটি করে কাজ সম্পন্ন করা।

উপরের দুইটি বিষয়ের সাথে আরো একটি বিষয় যুক্ত না করলেই না, আর তা হল আত্ম-সচেতনতা। যদি কখনো এমন হয় যে উপরের উল্লেখিত  বিষয় দুইটি সফলভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না, তখন সচেতনভাবে নতুন একটি কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি করা।

মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ

যখন আপনি মানসিকভাবে বিষাদগ্রস্থ থাকবেন তখন খুব স্বাভাবিক যে এর প্রভাব আপনার কাজের উপরও পড়বে।তাই আপনি এবং আপনার সাথে যারা কাজ করছে তাদের অবশ্যই মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকতে হবে।

মানসিক চাপের প্রভাব: মানসিক চাপের প্রভাব নিয়ে একজন লেখক লিখেছিলেন যে, একজন দলনেতার কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে একটি প্রতিষ্ঠানকে বাৎসরিক প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলারের মাশুল গুনতে হয়েছিল। মানসিক চাপের কারণে কর্মীদের মাঝে নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দেখা গিয়েছিল-

  • অনুপস্থিতি
  • কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়া
  • দুর্ঘটনা
  • এবং আরও নানাবিধ সমস্যা

এছাড়াও আরো চমকপ্রদ কিছু তথ্যের কথা লেখক উল্লেখ করেছেন –

  • কলকারখানায় যেসব দুর্ঘটনা ঘটে থাকে তার প্রায় শতকরা ৭৫ থেকে ৮৫ ভাগ ঘটে থাকে মানসিক চাপ থেকে।
  • আমেরিকায় আলোচিত ৬টি মৃত্যুর কারণ ছিল মানসিক চাপ।
  • প্রায় শতকরা ৬৬ ভাগ মানুষ মানসিক চাপের কারণে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন।
  • প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ বিকলাঙ্গতার জন্য দায়ী মানসিক চাপ।
  • মানসিক চাপের কারণে কাজের ব্যাপক বিঘ্ন ঘটে থাকে।

মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের একটা উপায় হতে পারে ব্যায়াম অথবা লক্ষ্যের প্রতি অটল থাকা। আপনি কতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পারেন, কতটুকু পরিবর্তন আনতে পারেন এবং কতটুকু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন কেবলমাত্র এইটুকুর উপরই আলোকপাত করুন, এছাড়া বাকি যা কিছু আছে সব মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন।

এই পাঁচটি নীতি মানসিক দৃঢ়তা তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা কিনা পরবর্তী দুইটি নীতি বাস্তবায়নের উপর নির্ভরশীল।

মূল্যবোধ

কোন বিষয়টি আপনার কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সে ব্যাপারে যদি আপনার সঠিক ধারণা না থাকে তাহলে সুযোগ আপনার কাছে সব সময় অধরা থেকে যাবে। মূল্যবোধগুলোকে সিঁড়ির একেকটি ধাপ হিসেবে বিবেচনা করুন যা আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে। যখন আপনি আপনার মূল্যবোধগুলো আপনার অধীনস্থদের সাথে আলোচনা করবেন, তখন আপনি সবার জন্য আচার-আচরনের ব্যাপারে একটি মাত্রা নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। বস কি চায় এই ব্যাপারে যখন অধীনস্থরা যখন অবগত থাকে, তখন তারা অনেক ব্যাপারেই সচেতন হয়ে যায়।

যদি আপনি না জানেন যে, আসন্ন সাফল্য আপনার জন্য কতটুকু গুরুত্বপূর্ন তাহলে আপনি সেই সাফল্য কখনোই ধরে রাখতে পারবেন না এবং লক্ষ্য চ্যুত হবেন খুব শীঘ্রই।

বিশ্বাস

নিজের উপর আস্থা এবং বিশ্বাস রাখতে হবে, নিজের অধীনস্থ ব্যক্তিদের উপর এবং কর্মরত প্রতিষ্ঠানের উপর ভরসা করতে হবে যে আমাদের দ্বারাই এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। আমি এমন অনেক ব্যক্তিকে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করতে দেখেছি কারণ তারা নিজেদের চেষ্টার উপর বিশ্বাস রেখেছিল।

একটি অনন্য মানসিক দৃঢ়তা দিনে দিনে বাড়তে থাকে, এটা এমন একটা জিনিস যা কখনো অর্জন করা যায় না কেবলমাত্র দিনে দিনে শাণিত করা যায়। উপরে উল্লিখিত ৭টি বিষয়ের প্রত্যেকটি বিষয়কে যখন একত্রিত করে একটি লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে কাজ সম্মাদন করা হবে, নিঃসন্দেহে সাফল্য অর্জিত হবে।

লিখেছেন জেফ বস।

www.forbes.com সাইটে মূলত প্রকাশিত।

আপনি উদ্যমী!
আপনার জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চান?  

তাড়াতাড়ি সাবস্ক্রাইব করুন।

আমাদের সেরা কনটেন্ট আপনার ইমেইলে পৌছে যাবে প্রতি সপ্তাহে।  

Invalid email address
আপনি যেকোনো সময় আনসাবস্ক্রাইব করতে পারবেন।  

মন্তব্য করুন