মায়ের হতাশা প্রভাবিত করে শিশুর স্বাস্থ্যকেও!
সন্তানের জন্মের পর শতকরা ৯ জনের মধ্যে প্রতি একজন নারীর মধ্যে হতাশার লক্ষণ দেখা যায়। এই লক্ষণের মধ্যে রয়েছে – মেজাজ ঠিক না থাকা, অবসাদ বোধ করা এবং কোনো কাজে আগ্রহবোধ না করা ইত্যাদি – যেটি কিনা একজন সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর সাথে মায়ের সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে।
শিশুরা পরিবার থেকে ছোটবেলায় যেমন ব্যবহার পায়, তার ভবিষ্যৎ আচরন এবং জীবনযাপন পদ্ধতি তেমন করেই নির্ধারিত হয়। বন্ধুসুলভ পরিবার থেকে উঠে আসা শিশুরা তাই পরবর্তী জীবনে হয়ে ওঠে ইতিবাচক, সাহসী এবং সুস্থ। অন্যদিকে, এর বিপরীত পরিবার থেকে উঠে আসা শিশুরা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
উল্লেখ্য, বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত মায়ের কাছ থেকে আসা আবেগের কারণে শিশুস্বাস্থ্য কীভাবে প্রভাবিত হয় সেটা নির্ধারণ করতে পারেননি। তবে আমাদের নভেম্বরে প্রকাশিত একটি গবেষণায় মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং তার সাথে শিশুর কোষের ধ্বংস হওয়া- এই বিষয়ে কাজ করা হয়েছে।
টেলোমেরস ও স্বাস্থ্য
মানসিক চাপ আমাদের কীভাবে প্রভাবিত করে? এই গবেষণার একটি অংশে কথা বলা হয়েছে টেলোমেরসকে নিয়ে।
আমাদের জীবন কতটা স্থায়ীত্ব বুঝতে সাহায্য করে টেলোমেরস। ডিএনএ-কে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য ক্রোমোজোমের দুই মাথায় টুপির মতো পরানো থাকে টেলোমেরস। অনেকটা জুতোর ফিতার দুই মাথায় পরানো দুটো শক্ত অংশের মতো।
এই টেলোমেরসকে জীবনঘড়ির সাথে তুলনা করা হয় কারণ, এটি একজন মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তুলনামূলকভাবে ছোট হতে থাকে। ফলে মানুষের শরীরে দেখা দেয় ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, স্মৃতিহীনতা, হৃদপিণ্ডের সমস্যাসহ আরো নানাবিধ রোগ। মজার ব্যাপার হল, কেবল বয়স নয়, আমাদের মানসিক চাপও এই টেলোমেরস ছোট করে দিতে ভূমিকা রাখে।
অসম্ভব মানসিক চাপে পরলে আমাদের শরীর করটিসল নামক একটি হরমোন নিঃসরণ করে। যেটা কেবল আমাদের আবেগকেই নিয়ন্ত্রণ করে না, সেইসাথে প্রভাবিত করে মেটাবলিজম, স্মৃতি এবং নতুন কিছু শেখার মতো ব্যাপারগুলোকেও। পুরো প্রক্রিয়াটিকে একসাথে দেখলে খুব সহজেই বোঝা সম্ভব যে, কীভাবে মানসিক চাপ, টেলোমেরস এবং আমাদের জীবন একসাথে সংযুক্ত। করটিসলের পরিমাণ যত বেশি হবে, শরীরের কোষ ততো বেশি দূর্বল ও কম টেলোমেরসের অধিকারি হবে।
এই প্রক্রিয়াকে মানসিক চাপের শারীরিক সমস্যায় পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া বলা যেতে পারে। মা যখন অসম্ভম হতাশ থাকেন, তখন শিশুদের মধ্যে সেই মানসিক চাপের প্রভাব পড়ে এবং এতে করে শিশুরা কিছু বোঝার আগেই ছোটবেলা থেকেই কম টেলোমেরস নিয়ে বেড়ে ওঠে। প্রতিনিয়ত সেই পরিমাণ আরো কমতে থাকে। প্রভাব পড়ে তাদের শরীর, মন এবং আয়ুষ্কালের উপরেও।
আমাদের গবেষণা
আমরা পরীক্ষায় পেয়েছি যে, মায়েদের এই হতাশ হওয়ার লক্ষণগুলো শিশুদের প্রভাবিত করে এবং কোষ ধ্বংসের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে ভূমিকা রাখে।
শিশুরা জন্মের পর থেকে শুরু করে বেড়ে ওঠার সময় পর্যন্ত অনেক বেশি সহানুভূতিশীল হয়ে থাকে। যেকোনো নেতিবাচক ব্যাপার, বিশেষ করে মায়ের পক্ষ থেকে আসা কোনো আবেগ তাদেরকে প্রভাবিত করে খুব দ্রুত। ব্যাপারটি কি সত্যিই এরকম? গবেষকেরা গবেষণা করেছেন। বেশকিছু শিশুকে তারা পরীক্ষা করেন। দেখা যায়, হতাশ এবং মানসিক চাপে ভুক্তভোগী মায়েদের শিশুরা সমাজিক সঙ্গ থেকে দূরে থাকতে ভালোবাসে। মানুষের ভিড়ে নয়, এর বাইরে নিজেকে রাখতে পছন্দ করে। একলা থাকতে পছন্দ করে।
কেবল তাই নয়, ১২ সপ্তাহ বয়সী শিশু এবং তাদের মায়েদের নিয়ে আরেকটি গবেষণা চালানো হয়। সেখানে মোট ৪৮ জন মা এবং তাদের শিশুরা শিশুদের ১৮ মাস হওয়া পর্যন্ত গবেষণাগারে এসে কিছুক্ষণ সময় কাটান। এই সময় কিছু শিশুকে তাদের মায়েরা পুরোপুরি মনোযোগ দেন এবং খেলাধুলা করেন। অন্যদিকে, বাকি শিশুদের মা তাদের সন্তানের কাজে ও খেলায় আগ্রহী না হওয়ার মনোভাব দেখান।
এই পুরোটা সময় শিশুদের মুখের লালা থেকে পরীক্ষা করা হয় তাদের শরীরের করটিসলের পরিমাণ। ১৮ মাস পূর্ণ হলে তাদের লালা থেকে টেলেমরস নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখা যায় যে, যে শিশুরা মায়েদের কাছ থেকে মনোযোগ পেয়েছে তাদের ডিএনএ-তে বাকীদের চাইতে টেলোমেরসের পরিমাণ কম ও আকৃতি সংক্ষিপ্ত।
উন্নত মানসিক স্বাস্থ্য
মা এবং শিশুর মধ্যকার আবেগীয় আদানপ্রদান এবং শিশু, বিশেষ করে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুদের মানসিক অবস্থা বুঝতে এমন গবেষনা অনেক করা হয়েছে।
শিশুরা ছোটবেলায় অনেক বেশি তথ্য নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। তার সেই সময়ে পাওয়া অভিজ্ঞতাগুলো পরবর্তী জীবনে অনেক বড় প্রভাব রাখতে পারে। যার জন্য কেবল গবেষণা করলেই হবে না, বরং আর অনেক বেশি সচেতন থাকতে হবে। ছোটবেলায় শিশু যেন মানসিক চাপ, নেতিবাচক আবেগ, হতাশার মুখোমুখি না হয় এবং শিশুর মা যেন মানসিক অস্থিরতা এবং হতাশা থেকে বের হয়ে আসতে পারে সেজন্য তাদের সাথে কথা বলতে হবে। এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা করতে হবে।
আমাদের মতে, এই গবেষণাগুলোর মাধ্যমেই বোঝা যায় যে, মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য এবং শিশুদের ছোটবেলায় বেড়ে ওঠার বিষয়ে আরো বেশি গুরুত্ব নিয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।
www.theconversation.com সাইটে মূলত প্রকাশিত।
মন্তব্য করুন