নেতৃত্ব: যা একজন নেতাকে বস থেকে আলাদা করে
ছোট কিংবা বড়- আপনি যে ধরণের দলকেই নেতৃত্ব দেয়ার চেষ্টা করবেন, সেখানে সবসময়ই প্রতিকূলতা আছে যা নেতৃত্বকে কঠিন করে তোলে। হয়ত আপনার দল কোন একটা বিপত্তি মোকাবেলা করছে এবং এই মুহূর্তে তাদের মনোবল ভঙ্গুর। হয়ত দলের কোন কোন সদস্য অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করতে পারছে না। অথবা হয়তো দলের অন্যরা আপনি যা বলতে চাচ্ছেন তা বুঝতে পারছে না, এটাকে কঠিন করে তুলছে এবং তাদের কাজ সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছে না।
নেতৃত্ব কখনোই খুব সোজা কিছু না। কিন্তু আপনি যদি বোঝেন নেতৃত্ব বলতে কী বোঝায়- তাহলে একজন সফল নেতা হওয়া থেকে আপনি মাত্র এক পা দূরে আছেন।
নেতৃত্ব হচ্ছে একটা শিল্প যা অন্য সবাইকে একটা সম্মিলিত লক্ষ্যের দিকে একসাথে পরিচালিত করে।
নেতৃত্তের কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। এটা নির্ভর করে নেতার ধরনের উপর- কোন কোম্পানির সিইও, ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন, একজন ধার্মিক নেতা, রাজনৈতিক নেতা প্রভৃতি। কিন্তু আমরা যখনই সাধারণভাবে নেতৃত্ব নিয়ে কথা বলি, নেতৃত্ব বিশেষজ্ঞ জেমস ম্যাকগ্রেগর বার্নসের মতে, নেতৃত্ব একটা প্রক্রিয়া যেখানে নেতা এবং তার অনুসারীরা একে অপরকে নৈতিকতা ও প্রেরণার এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। একজন নেতা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে ও দলের অন্য সদস্যদের সম্মিলিত লক্ষ্যের দিকে একসাথে কাজ করতে অনুপ্রেরণা যোগায়।
একজন ভাল নেতা অন্যদের বেড়ে উঠতে ও তাদের সেরা কাজটা করতে অনুপ্রাণিত করে।
একজন নেতা হচ্ছেন একদল লোকের মধ্যে সহজাত প্রতিভার অধিকারী যার নেতৃত্ব দেয়ার, অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করে অন্যদের ব্যক্তিগত উন্নযনের পাশাপাশি দলগত লক্ষের দিকে পরিচালনা করার দক্ষতা রয়েছে। নেতারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যেহেতু দলের কর্মদক্ষতার উপর তাদের বেশ প্রভাব আছে। ভালো নেতারা দলের কর্মদক্ষতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নেয়, ইতিবাচক সংস্কৃতি চালু ও দলের সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে।
একজন বড় নেতা দলের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার উৎস।
একজন ভালো নেতা দলের কঠিন সময়ে সবার সাথে মিলে কাজ করে, সেই সাথে অন্যদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়। এটা সৃজনশীলতাকে উস্কে দেয় ও দলকে সম্মিলিতভাবে উপকৃত করে। এটা একই সাথে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা দলের অন্য সদস্যদের দলের জন্য অবদান রাখতে উৎসাহিত করে।
একজন বড় নেতা মূল্যবোধ উন্নত করতে দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ স্থাপন করেন।
একজন বড় নেতা তার দলের জন্য রোল মডেল। তিনি একটা মানদন্ড স্থাপন করেন যা অন্যরা ধারাবাহিকভাবে নিজেদের আচরণ, যেমন: সময়ানুবর্তিতা, সততা প্রভৃতির মাধ্যমে অনুসরণ করে এবং দলের সাফল্যে অবদান রাখে।
সব সফল নেতার মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে।
যদি আপনি একজন ভালো নেতা হতে চান, সফল নেতাদের এই বৈশিষ্ট্যগুলোর সম্পর্কে জানুন।
১) দূরদর্শিতা
দূরদর্শিতা হচ্ছে বেশ খানিকটা ভবিষ্যৎ দেখতে পারা এবং দলের অর্জনের জন্য লক্ষ্য ঠিক করার সামর্থ্য। একজন নেতা দলকে ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করে সঠিক দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ব্যাপারে সাহায্য করেন। দূরদর্শিতা ছাড়া একজন নেতা দলের জন্য বিভ্রান্তিকর পরিকল্পনা করেন যা দলগত ফলাফলের জন্য ক্ষতিকর।
২) নিবেদিত
একজন নেতার নিজের কর্তব্যে দায়বদ্ধতা মানে উদাহরণের সাথে নেতৃত্ব দেওয়া। আপনি যদি দলের একজন সদস্য হন, আপনি কি এমন কাউকে অনুসরণ করবেন যিনি অন্যদের জন্য বেঁধে দেয়া নিয়ম নিজেই মানেন না? বোধহয় না। একজন নেতার নিজের জন্য উচু মানদন্ড ও তার জন্য নিরলসভাবে কাজ করতে হয়, যেন অন্য সদস্যরা তার নেতৃত্বকে সম্মান করে।
৩) কৌতুহলী
একজন নেতাকে উদ্ভূত যেকোন সমস্যা সমাধানে সাহায্য করার জন্য তিনি কি করছেন সেই সম্পর্কে সচেতন হতে হয়। তারা সাধারণত কৌতূহলী হয় ও কখনই শেখা থামায় না। তাদের অবশ্যই দলের অন্য সদস্যদের সম্পর্কে ভাল জ্ঞান রাখা উচিত। জ্ঞান ও কৌতূহল ছাড়া কেউ কোন দলকে সমস্যা সমাধানের দিকে এগিয়ে নিতে পারে না। এবং দলের অন্যান্য সদস্যরাও তার কর্তৃত্বতে আপত্তি জানাতে পারে।
৪) আত্মবিশ্বাসী
আত্মবিশ্বাস হচ্ছে আক্রমনাত্মক না হয়ে নিজের উপর আস্থা রাখা। একজন নেতাকে সময়ে সময়ে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হয়, যেন দলের অন্য সদস্যরা তার নির্দেশ ও পরিকল্পনা অনুসরণ করতে ভরসা পায়। একজন নেতা একটি দলের কল্যান ও উদ্বেগের প্রতিনিধিত্ব করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটা জটিল কাঠামোর কোম্পানিতে একজন নেতা অন্য সদস্যদের অধিকারের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তখনই আত্মবিশ্বাস জরুরি হয়ে পড়ে।
৫) নৈতিকতা
সততা একজন সম্মানিত নেতার মধ্যকার সহজাত গুণ। একজন অসৎ নেতা, যার কাজ ও কথার মধ্যে কোন মিল নেই, কদাচিৎ দলের অন্য সদস্যদের সম্মান পেয়ে থাকেন। আর সম্মান ছাড়া একজন নেতা দলকে কোনকিছু অর্জন করার জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারেন না, যা দলকে অদক্ষতার দিকে চালিত করে।
৬) বিশ্বাস
একজন নেতাকে দলের অন্য সদস্যদের দক্ষতার উপর আস্থা রাখতে হয়। প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর দলের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের জন্য হেঁটে বেড়ালে বা অন্যদের সব কাজের বিরোধিতা করলে দলের মধ্যকার বিশ্বাস স্থাপিত হয় না। দলের অন্য সদস্যদের প্রতি আস্থা না রাখা ও তাদেরকে তাদের কাজটা করতে যথেষ্ট স্বাধীনতা না দেয়া, কেউই এমন বিরক্তিকর নেতাকে পছন্দ করে না।
৭) স্থিরবুদ্ধি
দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়াটা ব্যবসা ও কোম্পানির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দলগতভাবে বেশ চাপ ও অল্প সময়ের মধ্যে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তখনই একজন নেতা নিজের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে এবং নিজের জ্ঞান ও অন্য সদস্যদের মতামত নিয়ে দেরি হওয়ার আগেই দ্রুত সিদ্ধান্ত প্রদান করেন।
৮) ইতিবাচক
নেতৃত্তের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে- আশাবাদীতা। এমন অনেক সময় আসবে যখন দলের মনোবল খুবই দুর্বল কিংবা কোন একটা প্রজেক্টের মাঝপথে নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলেছে। একজন ইতিবাচক নেতা খারাপের মাঝেও ভালোটা খুঁজে বের করেন এবং দলের অন্য সদস্যদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা যোগান। অন্যদিকে একজন নিরাশাবাদী নেতা দিনশেষে ভালো কিছুতে খুব কমই বিশ্বাস করেন।
৯) নিরহংকারী
একজন মার্জিত নেতা তার নিজের কর্মদক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অর্জনের ব্যাপারে সচেতন থাকেন এবং তারা আরও ভাল কিছু করতে পারে কিনা সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখেন। নিজের দিকে তাকিয়ে একজন নেতা প্রতিনিয়ত বুঝতে পারেন তারা কিসে ভালো, কিসে মন্দ এবং কিভাবে নিজেদের আরও উন্নত করা যায়।
উপরে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যগুলো কম সময়ের মধ্যে অর্জন করা সম্ভব না। কিন্তু একজন ভালো নেতা হওয়ার জন্য আপনি এগুলো শিখতে ও অনুসরণ করতে পারেন।
একজন ভালো নেতা হওয়ার জন্য বড় বড় নেতাদের অনুসরণ করুন।
সফল নেতাদের কাছ থেকে সবসময় কিছু না কিছু শেখার রয়েছে। আপনি যার মতো হতে চান, সেই নেতাকে অনুসরণ করার মাধ্যমে আপনি একজন ভালো নেতা হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করতে পারেন। আপনার পছন্দের পাঁচজন নেতাকে বেছে নিন, নিজেকে জিজ্ঞেস করুন কেন আপনি তাদেরকে পছন্দ করেন। এটা কি তাদের বাচনভঙ্গির জন্য, তাদের আচরণ, আত্মবিশ্বাস নাকি তারা অন্যদের যেভাবে সম্মোহিত করে রাখে সেটার জন্য? আপনার মতে একজন সফল নেতার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতাগুলো শিখতে শুরু করুন। এবং আপনার প্রতিদিনকার জীবনে অনুশীলন করুন।
মনে রাখবেন- আপনি শুধু তাদের সাফল্য থেকেই না, বরং তাদের ভুলগুলো থেকেও শিখবেন। হেনরি ফোর্ডের দিকে তাকান। ফোর্ড মোটর হয়তো আজকে একটি সফল কোম্পানি, কিন্তু ফোর্ড ব্যর্থতা দিয়েই এটা শুরু করেছিলেন। নিজের প্রতিটি সূক্ষ্ম ভুল ও তার ভেতরকার লুকানো সমস্যার প্রতি মনোযোগ দেয়াটাই তার সাফল্যের চাবিকাঠি।
অন্যদের কিছু শেখানোর জন্য প্রতিদিনই আপনার কাজের ক্ষেত্রে নতুন কিছু না কিছু শিখুন।
এটা অতিরঞ্জিত শোনাতে পারে, কিন্তু এটা সবসময় সঠিক- ‘বোকা থাকো, ক্ষুধার্ত থাকো।’
নিজের কাজ ও বাজারের ব্যাপারে প্রতিদিন নতুন কিছু না কিছু শিখুন যা আপনাকে একজন চমৎকার নেতায় পরিণত করবে। কখনো শেখা থামাবেন না। কি শিখলেন সেটা লিখে রাখার ব্যাপারে ভুল করবেন না, কারন একদিন আপনার দলের সদস্যরা এ ব্যাপারে আপনার উপদেশ চাইতে পারে, সেদিনের জন্য আপনার জ্ঞান সঞ্চয় করে রাখুন।
সবসময় প্রতিক্রিয়া জানতে চান, একজন কর্মঠ নেতা কখনো অপেক্ষা করেন না।
সকল নেতাদের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- তারা সবসময় উন্নতি করতে চান। দলের সদস্যরা আপনাকে প্রতিক্রিয়া দেবে, তার জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চান। সমালোচনার ব্যাপারে উদার থাকুন কারণ সবারই দুর্বলতা রয়েছে এবং দলের সদস্যদের নির্ভীক মতামত একজন নেতার উন্নতির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আপনি কি একজন নেতা হতে প্রস্তুত? সময় নষ্ট করা বন্ধ করুন ও এখনই আপনি যেসব নেতাদের পছন্দ করেন তাদের কাছ থেকে শিখতে শুরু করুন। মনে রাখবেন- ভুল হতেই পারে এবং এটাই স্বাভাবিক। নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন ও ভুল করতে ভয় পাবেন না।
লিখেছেন এমিলি চু।
www.lifehack.org এ পূর্বপ্রকাশিত।
মন্তব্য করুন