ক্যান্সার ও চিনির মধ্যকার মারাত্নক সম্পর্ক

Share

ক্যান্সারের কোষরা হচ্ছে বিদ্রোহী ধরণের। তারা যেখানে যাওয়া উচিৎ না ঠিক সেখানেই যায়, নিজেদের আশেপাশের বেপরোয়া কোষদের সাহায্যে কর্তৃপক্ষকে নাজেহাল করে। আর তাদের এই নিষ্ঠুর বিদ্রোহে পথে তারা জীববিজ্ঞানের অসংখ্য আইন ভাঙে।

তাছাড়া তারা বেশ অদ্ভুতও। তাদের আইন ভাঙ্গার একটা উদ্ভট উদাহরণ হচ্ছে- শর্করা বা চিনির বিপাক। অক্সিজেনকে কাজে লাগিয়ে দেহের সাধারণ কোষেরা জারণ প্রক্রিয়ায় গ্লুকোজ ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন করে। এই প্রক্রিয়ায় কোষগুলো ৩৬ অনু এটিপি তৈরী করতে পারে, যা শরীরে অনেকটা নগদ টাকার মতো কাজ করে। ব্যাপারটা এমন- কোষগুলো কিছু কাজ করলো ও বিনিময়ে এই নগদ টাকা পেলো যা কীনা তারা খরচ করতে পারে।

কিন্তু ক্যান্সার কোষগুলো কম টাকার বিনিময়ে অনেক বেশি কাজ করে। তারা পুরনো আমলের ১০ ধাপের গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ায় গ্লুকোজ ভেঙ্গে মোটে ২ অনু এটিপি রোজগার করে গ্লুকোজপ্রতি।

এই গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন ছাড়াও কোষগুলো শক্তি উৎপাদন করতে পারে। যা কীনা পানিতে থাকতে আমাদের আদিম পূর্বপুরুষকে করতে হতো। তাছাড়া এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া ও ইস্টরাও এটা করে। তারা গাঁজন প্রক্রিয়ায় শর্করা থেকে শক্তি সংগ্রহ করে। কিন্তু অক্সিজেন থাকার পরও গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ায় শর্করা থেকে শক্তি উৎপাদনের ব্যাপারটা অনেকটা মশা মারতে কামান দাগার মতো। অল্প লাভের জন্য বিশাল পরিশ্রম।

এখানেই শেষ না। এই পাগলাটে বিদ্রোহ চালানোর জন্য ক্যান্সার কোষগুলোর অনেক শক্তির দরকার হয়। আর তারা এমনভাবে শর্করা হজম করতে থাকে যেন শরীরটা একটা মগের মুল্লুক।

১৯২০ সালে অটো ওয়ারবার্গ নামের একজন জার্মান বায়োকেমিস্ট প্রথমবারের মতো ক্যান্সার কোষগুলোর এইসব অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করেন। তখন তিনি কোষের ‘পাওয়ার হাউস’ হিসেবে পরিচিত মাইটোকন্ড্রিয়া’র ত্রুটিকে এই অদ্ভুত আচরণের জন্য দায়ী করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন এই অদ্ভুত বায়ুজীবি গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়াই (পরে যার নামকরণ করা হয় ‘ওয়ারবার্গ ইফেক্ট’) আসলে ক্যান্সার ঘটায়। যদিও কিভাবে ও কেন এটা হয়- তার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা ছিলো না।

এই ধারণাটি পরবর্তী কয়েক দশক কিছুটা চাপা পড়ে থাকে। কেননা গবেষকরা তখন ক্যান্সারের অন্যান্য তাত্ত্বিক ব্যাপারগুলোর দিকে মনোযোগী ছিলেন ও ক্যান্সার ছড়িয়ে যাবার জন্য জিনগত পরিবর্তনকে সন্দেহ করছিলেন। কিন্তু বর্তমানে ‘ওয়ারবার্গ ইফেক্ট’ ও ক্যান্সারের বিপাকীয় তত্ত্বের উপর আবার আলো পড়তে শুরু করেছে।

তবু বিপাকীয় তত্ত্বের উপর যতই গুরুত্ব আরোপ করা হোক না কেন, দুটি বিব্রতকর বড় প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রথমটি হলো- কেন? কেন ক্যান্সার কোষগুলো, যাদের এতো বেশি শক্তি দরকার, এমন একটি অদক্ষ প্রক্রিয়ার সাথে বিবর্তিত হয়ে খাপ খাইয়ে নেয়? দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে- কিভাবে? ঠিক কি উপায়ে বায়ুজীবী গ্লাইকোলাইসিস ক্যান্সারের প্রক্রিয়াকে চালনা করে। নাকি এটা কোষের অতিরূপান্তরের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া?

প্রথম প্রশ্নটি এখনো রহস্যে ঢাকা। কিন্তু দ্বিতীয়টির বেলায় বলা যায়- তিনটি বেলজিয়ান গবেষণা দল একটি নতুন ধারণা প্রকাশ করেছেন। এতে তারা নিখোঁজ হওয়া সম্ভাব্য আনবিক সংযোগ উন্মোচন করেছেন- অন্ততপক্ষে তাদের মধ্যে থাকা সূত্র। নয় বছর ইস্টের মডেলের উপর কাজ করার পর, দলগুলো গ্লাইকটিক পথে একটি মূল শর্করা অনু (ফ্রুক্টোজ-১,৬-বাইফসফেট) ও  একটি জটিল জিনের মধ্যকার সংযোগ শনাক্ত করতে পেরেছেন। রাস নামের এই জিনটি হচ্ছে কোনো কোষের বিভাজন ও টিকে থাকার সামর্থ্যের কেন্দ্রবিন্দু। এটা হচ্ছে একটা বিখ্যাত অঙ্কুজিন, যা পরিবর্তিত হয়ে কোষের অতিরূপান্তরে প্রভাব রাখে। প্রায় অর্ধেকের মতো ক্যান্সারেই রাসের এই পরিবর্তিত রূপ খুঁজে পাওয়া গেছে।

নেচার কমিউনিকেশনের শুক্রবারের অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই গবেষণার লেখকরা জানান যে, রাস জিন ও চিহ্নিত শর্করার মধ্যে একটা পারষ্পরিক যোগাযোগ ক্যান্সার কোষদের একটা দুষ্টচক্রে বন্দী করতে পারে, যার ফলে কোষদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত গ্লাইকোলাইসিস উভয়ই ঠিক থাকবে। এটা কোষদের বৃদ্ধির হার এবং ক্যান্সার কোষদের মারমুখো চরিত্রের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে।

‘ওয়ারবার্গ ইফেক্ট’র শক্তি ও টিউমারের মারমুখী ভঙ্গির মধ্যকার পারষ্পরিক সম্পর্ক বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এক প্রেস বিবৃতিতে গবেষণাটির অন্যতম একজন জোহান থেভেলিন বলেন, এটা ‘ক্যান্সারের বৃদ্ধি ও বেড়ে ওঠা এবং অব্যাহত উদ্দীপনার একটা দুষ্টচক্র’।

এই আবিষ্কারটি আমাদের জন্য বড় একটি অর্জন। এটা ক্যান্সার রোগীদের খাদ্যাভাসে ভালো প্রভাব রাখতে পারে। আর আমাদের জন্য, এটা আরেক টুকরো প্রমাণ যা কীনা আমাদের অতিরিক্ত পরিমাণে চিনি খাওয়ার কুফল সম্পর্কে সচেতন করে। এবং এখন ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার জন্য সম্ভাব্য একটা পদ্ধতি আছে আমাদের কাছে।

লিখেছেন ক্লিফটন লিফ।
www.fortune.com-এ পূর্ব প্রকাশিত।

আপনি উদ্যমী!
আপনার জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চান?  

তাড়াতাড়ি সাবস্ক্রাইব করুন।

আমাদের সেরা কনটেন্ট আপনার ইমেইলে পৌছে যাবে প্রতি সপ্তাহে।  

Invalid email address
আপনি যেকোনো সময় আনসাবস্ক্রাইব করতে পারবেন।  

মন্তব্য করুন