কর্নেল স্যন্ডারের জীবন কাহিনী: কিভাবে ১১টি সিক্রেট মশলার মিশ্রণ ব্যবহার করে কেএফসির প্রতিষ্ঠাতা আজকের একজন ধনশালী ব্যক্তিতে পরিণত হলেন
বিশ্বজুড়ে ফ্রাইড চিকেনের জন্য সুপরিচিত একটি ফাস্টফুডের দোকানের নাম কেএফসি।বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে দশকের পর দশক জুড়ে এটি আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি ফাস্টফুডের দোকান হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে।যদিও এর প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল স্যান্ডার সম্পর্কে খুব একটা বেশী কিছু জানা সম্ভবপর হয়ে উঠেনি।
তার সাফল্যের গল্পটা ঠিক আর পাঁচটা তরুণ উদ্যোক্তাদের মত নয়। তার সাফল্যের পিছনে রয়েছে অনেক সংগ্রামের ইতিকথা।তৎকালীন সময়ে ফ্রাইড চিকেনের ব্যবসার জনপ্রিয়তা দেখে তিনি এই ব্যবসার কথা চিন্তা করেন এবং কেন্টাকি শহরের রাস্তার ধারে একটি ছোট রেস্তোরাতে ফ্রাইড চিকেন বিক্রি শুরু করেন। তবে সেই পর্যন্ত আসতে তাকে প্রচুর প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
এক হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ, খুব অল্প বয়সে বাবাকে হারানো, ছোটকাল থেকে জীবিকার তাগিদে অর্থ উপার্জনের জন্য নেমে পড়া, একের পর এক পেশা পরিবর্তন করে নিরন্তর কাজ করে যাওয়া – এসবই ছিল ফ্রাইড চিকেনের হবু বাদশাহের জীবনের শুরুর দিকের কথা। জীবনের শুরুর দিকের এই ঘটনাগুলো তাকে ফুড ইন্ডাস্ট্রির দিকে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার দিকে ঠেলে দিয়েছিল এবং ৪০ বছর বয়সে তিনি একটি সার্ভিস স্টেশনও চালু করেন। এরপর নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে ফ্রাইড চিকেনের রেসিপিটিকে তিনি একটি অন্য মাত্রায় নিয়ে যান। তার জীবনের শুরুর দিকের ব্যর্থতা এবং সেই ব্যর্থতাগুলোকে কাটিয়ে উঠে পরবর্তীকালে তার সাফল্য সকলের কাছে অনুকরণীয়।
চলুন কর্নেল স্যান্ডারের অতীত জীবনথেকে ঘুরে আসা যাক এবং জেনে নেয়া যাক ফ্রাইড চিকেনের সাম্রাজ্যের অধিপতি হওয়ার গল্প সম্পর্কে:
শুরুটা বেশ কঠিন ছিল
১৮৯০ সালে ইন্ডায়ানা থেকে দূরে অবস্থিত একটি ফার্মে কর্নেল হার্ডল্যান্ড স্যান্ডার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন কঠোর পরিশ্রমী ব্যক্তি কিন্তু কর্নেলের বয়স যখন মাত্র ৫ বছর তখন তিনি ইন্তেকাল করেন। কর্নেলের ছোট দুইজন ভাইবোন ছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে, যদিও তাঁদের মা পরিবারের খরচ জোগানোর জন্য কাজ করতেন।
তাঁরা ভাইবোনেরা সকলেই দারিদ্রের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন এবং খুব ছোটকাল থেকেই তাঁদের অর্থ উপার্জনের জন্য কাজ করতে হত। কর্নেলের ১০ বছর বয়সে একজন খেতমজুর হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর কাজটি চলে যায় এবং যার কারণে কর্নেলের মা ভীষণ ভেঙ্গে পড়েন। মনিবকে কাজে সন্তুষ্ট করতে না পারার কারণে তিনি তাঁর ছেলেকে যথেষ্ট বকাবকিও করেন।কর্নেলের কাছে এই ঘটনাটি যথেষ্ট পীড়াদায়ক ছিল কিন্তু এই ঘটনা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি প্রতিনিয়ত কাজের সন্ধান করে গেছেন।
দৃঢ় প্রত্যয় এই বালক যেন পুরোদমে কাজ করতে পারেন, সেইজন্য তিনি স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে রং মিস্ত্রী, কন্ডাকটর ও সৈন্য হিসেবে কাজ করার মত তিনি প্রচুর কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এরপর তিনি ক্লিনার, দমকল কর্মী এবং কামার হিসেবেও কাজ করেছেন। তিনি আইন নিয়েও পড়াশোনা করেছেন এবং রেলে কাজ করার সময় যেসব শ্রমিক আহত হন তাদের লিগাল কাউন্সিলর হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। কিন্তু তাঁর এই পেশাটিও খুব দীর্ঘস্থায়ী ছিল না, শীঘ্রই তিনি ইনস্যুরেন্স বিক্রির কাজ শুরু করেন এবং পরবর্তীতে মিশিলিন টায়ার বিক্রির কাজে নিযুক্ত হন। ঘন ঘন পেশা বদলানোর জন্য তিনি জানতেন যে তাঁর ক্যারিয়ার সুস্থির নয়। অবশ্য এর মধ্যে কিছু কিছু কাজ থেকে তাঁকে বাদও দিয়ে দেয়া হয়েছিল।
হাল ছেড়ে দেয়ার বদলে এই অসফলতাগুলো তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
“প্রত্যেকেরই মনে রাখা উচিত যে প্রত্যেকটি অসফলতাই ভালো কিছু করার দিকে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়”।
ছয় বছর পরে তিনি একটি গ্যাস স্টেশন চালু করেন এবং একই সাথে সেখান দিয়ে যাওয়া নিত্য পথযাত্রীদের কাছে ফ্রাইড চিকেন বিক্রি শুরু করেন।
তাঁর ছোট ছোট ভাইবোনদের জন্য যেহেতু তাঁকে রান্না করতে হত সেই সুবাদে তিনি একজন ভালো রাঁধুনি হয়ে উঠেছিলেন এবং বহু রান্নার রেসিপি তাঁর ঝুলিতে জমা হয়েছিল। ফ্রাইড চিকেন বিক্রির পাশাপাশি তিনি সেইসব রেসিপির রান্না করা খাবার পথযাত্রীদের কাছে বিক্রি করতেন। সব খাবারের মাঝে তাঁর কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেন বহুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং এই জনপ্রিয়তার কারণে তিনি রাস্তার ধারেই ফ্রাইড চিকেন বিক্রি করার জন্য একটি রেস্তোরা চালু করেন।
রেস্তোরা চালু করার পর থেকে সেখানে আরো বেশি টেবিল রাখার ব্যবস্থা করা হয় যাতে করে আগের চেয়েও বেশি কাস্টোমার বসে খাবার খেতে পারে।দিনে দিনে তাঁর টেবিলের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং তাঁর এই সুস্বাদু চটকদার ফ্রাইড চিকেন দিনে দিনে আরো জনপ্রিয় হতে থাকে। তাঁর এই জনপ্রিয়তার কারণে তিনি স্টেট গভর্ণরের কাছ থেকে কেন্টাকি কর্নেল এর খেতাব পান, এ এক বিরল সম্মান যা গুটিকতক ব্যক্তিকে দেয়া হতো।
১০০৯টি অসফলতার পরে কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেনের জন্ম হয়
কিছুদিনের মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য আমেরিকা প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।যার ফলে রেস্তোরাতে কাস্টমারের সংখ্যা দিনে দিনে কমতে থাকে এবং একসময় কর্নেল রেস্তোরা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।কিন্তু তিনি তাঁর ফ্রাইড চিকেনের রেসিপিটিকে আরো সুস্বাদু এবং জনপ্রিয় করার জন্য মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে পুনরায় তিনি একটি রেস্তোরা চালু করবেন।
“আমার দুইটি নীতি রয়েছেঃ একটি নীতি হল তুমি যতটা করতে পার করে যাও এবং দ্বিতীয় নীতিটি হল যে সেই কাজগুলো সর্বোৎকৃষ্ট উপায়ে করার চেষ্টা কর।এই দুইয়ের সমন্বয়ে তুমি একটি কাজ সফল এবং সার্থকভাবে করতে সমর্থ হবে”।
তিনি একজন স্বপ্নদর্শী ছিলেন এবং তাঁর সফলতার যাত্রা শুরু হয়েছিল সবেমাত্র।তিনি বিশ্বাস করতেন যে ফ্রাইড চিকেনের জন্য তাঁর যে সিক্রেট মিশ্রণটি ছিল সেটি অন্যদের থেকে অনেকটা আলাদা এবং সকলেই তা অনেক পছন্দ করে। ফ্রাইড চিকেনের রেসিপিতে মোট ১১টি গুল্ম ও মশলার মিশ্রণ ব্যবহার করা হয় এবং এই মিশ্রণটাই তাঁর ফ্রাইড চিকেনকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।
যখন তাঁর বয়স ৫০ বছর, তখন তিনি রান্নার সময়টাকে কমিয়ে আনার জন্য একটি প্যাটেন্ট প্রেসার ফ্রাইয়ারে ফ্রাইড চিকেন রান্না করা শুরু করেন।তিনি দেশের ভিতরে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করতে আরম্ভ করেন এবং ফ্রাইড চিকেন রান্না করে তা সকলকে খাওয়াতে থাকেন। ৬০ বছর বয়সে, তিনি ঘুরেঘুরে ফ্রাইড চিকেন বিক্রি করতেন এবং বিভিন্ন ইউনিক টেকনিক ব্যবহার করে কিভাবে তিনি তা রান্না করতেন তা কাস্টমারদের সাথে শেয়ার করে আনন্দ পেতেন এবং রাতে তাঁর গাড়ির পিছনে ঘুমাতেন।
“তখন আমার বয়স ৬৬ বছর এবং আমার থাকার নির্দিষ্ট কোন জায়গা ছিল না। সামাজিক সুরক্ষার জন্য পাওয়া ১০৫ ডলারের দিকে আমার খেয়াল হল এবং আমি তা দিয়ে ফ্রাইড চিকেন বিক্রির জন্য একটি দোকান দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। লোকেরা সবসময়ই আমার ফ্রাইড চিকেন পছন্দ করেছিল”।
প্রায় ১০০৯টি অসফলতার পরে তিনি নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এটা প্রায় সবার জীবনেই ঘটে থাকে এবং নিজেকে প্রমাণ করার জন্য একটি সুযোগই যথেষ্ট। ১৯৫২ সালে সর্বপ্রথম কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেনের নামে একটি রেস্তোরা চালু করা হয়।
ব্যবসা প্রসারিত হতে থাকে
কর্নেল দ্রুতই সাফল্য লাভ করে এবং কেন্টাকি ফ্রাইড চিকেনের প্রায় ৬০০টি আউটলেট স্থাপিত হয়।
৭৩ বছর বয়সে তিনি ২ মিলিয়ন ডলারের(বর্তমানে যার মূল্য ১৫ মিলিয়ন ডলার)বিনিময়ে কেএফসি বিক্রি করে দেন।
তিনি নিয়মিতভাবে দেশের সকল কেএফসি রেস্তোরা পরিদর্শন করতেন এবং এখনো তাঁর দেয়া সেই লোগোটি ব্যবহার হয়ে আসছে।
বর্তমানে কেএফসি বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বড় চেইন রেস্তোরাগুলোর মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে এবং বিশ্বের প্রায় ২০,০০০টি জায়গায় এর শাখা রয়েছে। জাপানে, এটি একটি ক্রিসমাস ট্র্যাডিশনে পরিণত হয়েছে।
কর্নেল স্যান্ডারের চিকেনের সিক্রেট রেসিপিটি কেন্টাকির লুইস ভ্যালির একটি ভল্টে সুরক্ষিত রয়েছে।কিন্তু তিনি সবসময়ই হাসিমুখে তাঁর সাফল্যের রহস্য সবার সাথে শেয়ার করতে চেয়েছেন।কেএফসির মত একটি ব্র্যান্ড তৈরির পিছনে তাঁর সিক্রেট মিশ্রণের পাশাপাশি সাফল্যের আরেকটি স্তম্ভ ছিল সততা।
কর্নেল স্যান্ডারের জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষাঃ
আপনার অতীত কখনোই আপনার ভবিষ্যৎকে নির্ধারিত করে না।প্রকৃতপক্ষে শৈশবের সংগ্রাম,বয়স ও অসফলতাগুলো আপনাকে ভবিষ্যৎতের অকল্পিত সাফল্যের দিকে এগিয়ে দিবে।
কর্নেল কখনো হাল ছেড়ে দেননি। প্রচন্ড দূর্ভাগ্যের পরেও তিনি ৪০ বছর বয়সে তাঁর ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ৬০ বছরের আগে তাঁকে কেউ চিনত না এবং তাঁর প্রচেষ্টার কোন সুফল তিনি তখনো পাননি।
যখন বেশিরভাগ ব্যক্তি কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন তখন তিনি কেবলমাত্র সাফল্যের মুখ দেখেন।তাঁরসংকল্প, ধৈর্য ও দূরদর্শিতার কারণে তিনি আজ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।
www.goalcast.com সাইটে মূলত প্রকাশিত।
মন্তব্য করুন