একটি উদ্ভাবক টিম গড়ে তোলার ৪টি উপায়
আমার সিনিয়র ম্যানেজারদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটি পাই সেটি হলো- “আমরা কীভাবে আরো বেশি উদ্ভাবক লোক খুঁজে পেতে পারি?” আমি জানি তাদের মাথায় কোন ধরনের লোকের কথা থাকে— অনেক উদ্যমী আর গতিময়, অনেক বেশি ধারণাসম্পন্ন এবং সেগুলোকে দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করতে পারার দক্ষতা আছে এমন কেউ। আজকাল মনে হয় প্রায় সবাই প্রথম দিককার স্টিভ জবসকে খুঁজছে!
এমনকি আমার বই ‘ম্যাপিং ইনোভেশন’ এ গবেষণা করার সময়টাতেও আমি বুঝেছি যে শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবকেরা একদমই ছাঁচে ঢালা বা মার্কামারা কেউ ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে, তারা সবাই ছিলেন দয়ালু, উদার, এবং আমার কাজে আগ্রহী। এদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তিই ছিলেন মিতভাষী এবং নম্র। এরা এমন মানুষ, যাদেরকে ভিড়ের মধ্যেও আলাদা দেখায়।
তাই সবচেয়ে সহজ উত্তর হচ্ছে এই যে, আপনার প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে থাকা কর্মীদের শক্তি জোগানোর মাধ্যমেই শুরুটা করতে হবে। কিন্তু সেটি করতে গেলে আপনাকে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব নিতে হবে, যাতে আপনার লোকেরা নিজেদের মতো করে কাজ করতে পারে। এটি খুব সহজ নয়, এবং বেশিরভাগ ম্যানেজারেরই এ নিয়ে সমস্যা হয়। সে যা-ই হোক না কেন, কিছু সহজ নীতি মেনে চলার মাধ্যমে আপনি অনেক বড় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবেন।
কর্মীদের মিশনের খোঁজ করুন
আমার আগের কোম্পানিতে, আমাদের একজন বিভাগীয় ম্যানেজার ছিলেন, যিনি আশানুরূপ কাজ করছিলেন না। তিনি খুব খারাপও ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে, সব কর্মচারী, সহকর্মী এবং ঊর্ধ্বতন কর্মচারীরাও তাকে খুব পছন্দ করতো। কিন্তু তিনি ব্যবসাকে পরের ধাপে নিয়ে যাবার জন্য যে সৃজনশীলতাটুকু তার কাছ থেকে পাওয়া জরুরি ছিল, সেটি দিতে পারছিলেন না এবং আমরা তাকে চাকরিচ্যুত করবার সিদ্ধান্ত নিই।
এরপর একটি মজার ঘটনা ঘটে। তিনি আমাদের কোম্পানি ছেড়ে চলে যাবার পর একজন সফল ইন্টেরিয়র ডেকোরেটর হয়ে ওঠেন। তার ক্লায়েন্টরা তাকে খুব পছন্দ করতো এবং তিনি একটি শূন্যস্থানকেও তার সৃজনশীলতা ও নিজস্ব শৈলী দ্বারা অদ্ভুত রূপান্তর ঘটাতে পারতেন। তিনি সফল ম্যানেজারের মতোও বেশ কিছু দক্ষতা প্রদর্শন করেন। তিনি ভালো শ্রোতা ছিলেন, দক্ষ যোগাযোগকারী এবং ফলাফলের উপর তার মনোযোগ নিবদ্ধ থাকত।
তাহলে কেন একজন একটি অবস্থায় থেকে এত একঘেয়ে এবং কল্পনাশক্তিহীন বলে প্রমাণিত হলেন, যখন ঠিক একই ব্যক্তি অন্য অবস্থায় গিয়ে সৃজনশীল হয়ে উঠলেন? এর সবচেয়ে সহজ উত্তর হলো এই যে, তিনি আমাদের ব্যবসার চাইতে ইন্টেরিয়র ডেকোরেটিংয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন। গবেষকেরা অন্তর্গত অনুপ্রেরণাকে ব্যক্তিকে সৃজনশীল করে তোলার পেছনে একটি বড় প্রভাবক বলে দাবি করেন।
উদ্ভাবন সম্বন্ধে সবচেয়ে বড় অপব্যাখ্যা হচ্ছে এর ধারণাতেই। এটি তেমনটা নয়। এটি সমস্যার সমাধান সংক্রান্ত। তাই একটি উদ্ভাবক টিম গড়ে তোলার প্রথম ধাপ হলো তেমন কিছু লোক খুঁজে বের করা, যারা আপনার সমস্যাটি সমাধান করতে আসলেই আগ্রহী। যদি এই ভাগ করে নেওয়া কাজের মধ্যে সত্যিকারের কোনো দায়বদ্ধতা থেকে থাকে, তবেই ভালো ধারণার উৎপত্তি ঘটবে।
মানসিক নিরাপত্তার উন্নয়ন ঘটান
২০১২ সালে গুগল একটি বৃহৎ গবেষণা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল। এর সাংকেতিক নাম ছিল ‘প্রজেক্ট এরিস্টটল’, এর লক্ষ্য ছিল দলীয় ক্ষেত্রে সফলতার কারণ অনুসন্ধান করা। এই কোম্পানিটি একটি দলের একসাথে কাজ করার পেছনের কারণ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এবং প্রতিটি দিক খতিয়ে দেখে, যেমন— কীভাবে তাদের নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছে, কর্মক্ষেত্রের বাইরে তারা কতটুকু সম্পর্ক রাখে বা দেখা করে, দলের সদস্যদের ব্যক্তিত্বের ধরন ইত্যাদি – এবং চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখা হয়নি।
যা-ই হোক, গুগলের জটিল তথ্যানুসন্ধানের ক্ষেত্রে অতুলনীয় সক্ষমতা সত্ত্বেও, কোনো নির্দিষ্ট প্রথাগত ধরনই খুঁজে পাওয়া যায়নি, যা কিনা দলীয় পারফরমেন্সের ক্ষেত্রে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, দলের সফলতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকটি ছিল মানসিক নিরাপত্তা অথবা প্রতিটি সদস্যের সম্পূর্ণ নিসঙ্কোচে ও নির্ভয়ে নিজের ধারণাগুলো উপস্থাপন করবার সুযোগ।
শুধু গুগলেই নয়, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অ্যামি এডমন্ডসন হাসপাতালের দল থেকে অফিসের আসবাবের তৈরির কারখানা দল পর্যন্ত বিস্তৃত পরিসরে মানসিক নিরাপত্তার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, এটি শুধু পরিবেশের উন্নয়নই ঘটাতে পারে না বরং নতুন কিছু শিখার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং কানাগলিতে হারিয়ে যাবার প্রবণতাও কমিয়ে দেয়।
আরেকটি অধ্যয়নে দেখা গেছে, এমআইটি (MIT) এর গবেষকেরা এবং কার্নেগি মেলনের মতে, যেসব দলে লোকেরা কর্কশ স্বরে কথা বলে তারা, যেসব দলে এক বা দু’জন লোক কথোপকথনের নেতৃত্বে থাকে, তাদের চেয়ে অনেক বেশি পারফর্মেন্স দেখায়। তাই এই স্টিভ জবস ধরনের মানুষজন, যারা প্রায়ই বিভিন্ন ধারণার স্ফূরণ ঘটায় যেখানে অন্য কারো তেমন কিছু বলারই সুযোগ নেই তা অনেক সময় উদ্ভাবনীশক্তি কমে যাবার কারণ হয়।
মজার বিষয় হচ্ছে, অনেক বেশি ইনোভেটিভ টিম কিছু ধারণার জন্য নিরাপদ হলেও অন্যগুলোর জন্য নয়। যেমন, পার্কের (PARC) দুজন বিজ্ঞানী ডিক শউপ এবং অ্যাল্ভি রে স্মিথ সুপারপেইন্ট নামক একটি বৈপ্লবিক মাত্রার গ্রাফিক প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। দুর্ভাগ্যবশত, এটি পার্কের নিজস্ব কম্প্যুটিং দৃষ্টিভঙ্গির সাথে খাপ খায়নি, তাই এই দুজনকে বহিষ্কৃতকরে দেওয়া হয় এবং শেষমেশ তারা দুজনেই পার্ক ছেড়ে চলে যান।
স্মিথ এরপর আরেক গ্রাফিক উদ্যোক্তা এড ক্যাটমালের সাথে নিউইয়র্ক ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে দল গঠন করেন। এরপর তারা দুজন জর্জ লুকাসের সাথে যুক্ত হন, যিনি কম্প্যুটার গ্রাফিক্সের স্পেশাল ইফেক্টের সাথে নতুন মাত্রা যোগ করার ক্ষেত্রে সম্ভাবনার কথা জানতেন। পরবর্তী সময়ে এই প্রক্রিয়াটি চালিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে স্টিভ জবস তা কিনে নেন। পিক্সার নামের এই কোম্পানিটি ২০০৬ সালে ডিজনির কাছে ৭.৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যে বিক্রয় করা হয়।
বৈচিত্র্য সৃষ্টি করুন
অনেক ম্যানেজারই একটি নির্দিষ্ট ‘ধরন’ এর কথা মাথায় রেখে লোক নিয়োগ দেন, যারা সাধারণত তাদেরই মতো হয়ে থাকে। এটি হয়তো সহকর্মীদের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক এবং স্বস্তির জন্য খুবই ভালো, কিন্তু এটি কোনোভাবেই সমস্যা সমাধানের জন্য সবচেয়ে ভালো পরিবেশ নয়। প্রকৃতপক্ষে, বিভিন্ন ধরনের অধ্যয়নে দেখা গেছে যে বৈচিত্র্যপূর্ণ দলগুলো অপেক্ষাকৃত চৌকস, সৃজনশীল হয়ে থাকে এবং তারা যেকোনো বিষয় অনেক ভালো করে খতিয়ে দেখতে পারে।
সমস্যাটি তখন হয়, যখন আপনি আপনার দলের সদস্যদের ব্যাকগ্রাউন্ড, অভিজ্ঞতা এবং বাহ্যিক চেহারা— সবকিছুই একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে এনে ফেলেন। আপনি এতে করে বহু সম্ভাবনার সমাধানগুলোকেও সীমাবদ্ধ করে ফেলছেন। এতে করে আরো অনেক কম ধারণা পাওয়া যাবে এবং সবচেয়ে খারাপ হবে এই যে, আপনি একটি ‘ইকো চেম্বার’ গঠন করে ফেলবার ঝুঁকি নিচ্ছেন, যেখানে পরম্পরাপ্রাপ্ত পক্ষপাতিত্বের স্বাভাবিকীকরণ ঘটে ও জোরপূর্বক বারবার তা টেনে আনা হয়।
এর ফলাফল হিসেবে, একটি একই ধরনের দল গঠন করার মাধ্যমে আপনি এটি নিশ্চিত করছেন যে সর্বশ্রেষ্ঠ সমাধানগুলো অন্য কোথাও পাওয়া যাবে। তাই স্বস্তি খোঁজার বদলে, আপনার এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা উচিত যেখানে লোকেরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে অন্যের চেহারা, কথাবার্তা এবং চিন্তাভাবনার দ্বারা প্রতিনিয়ত অন্যরকম করে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে দেখবে।
ম্যানেজারদের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যেখানে একইসাথে বৈচিত্র্য এবং মানসিক নিরাপত্তা বিদ্যমান থাকবে। বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ থেকে জানা যায় যে বৈচিত্র্য বেশিরভাগ সময়ই ঐক্য কমিয়ে অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করে। যেকোনো দলই নিরাপদ থাকতে পারে যখন একে কেউ চ্যালেঞ্জ করছে না। শ্রেষ্ঠ ইনোভেটিভ দলগুলো এসব চাপের মধ্য দিয়ে গঠনমূলক কাজ করতে শেখে।
দলগত কাজের মূল্যায়ন করুন
সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং উৎসাহী যেসব ব্যাপার আমি আমার বইয়ের গবেষণা করতে গিয়ে পেয়েছি তা ছিল, আমি যাদের সাথে কথা বলেছি তাদের অধিকাংশই কত আন্তরিক ছিলেন। আমার কথা বলা লোকেদের মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী, বিভিন্ন জায়গার নির্বাহী সদস্য এবং উদ্যোক্তারা ছিলেন। তাই আমি ভেবেছিলাম এদের অনেকেই হয়তো খিটখিটে মেজাজের বা একটু কঠোর হবেন, কিন্তু এর পুরো উল্টোটাই ঘটেছিল।
প্রকৃতপক্ষে, প্রায় সবক্ষেত্রেই, আমি দেখেছি যে উর্ধ্বতন ইনোভেটররা অনেক বন্ধুভাবাপন্ন ও উদার ছিলেন এবং তারা আমার কাজে আন্তরিক আগ্রহ দেখান এবং সাহায্যের মনোভাব প্রকাশ করেন। তাদের আচরণ এতই দক্ষ ছিল যে কোনো দুর্ঘটনা হবার অবকাশই ছিল না। তাই আমি পরবর্তীতে আরো গবেষণা চালিয়ে যেতে পারি এবং এতে জানতে পারি যে যখন কোনোকিছু উদ্ভাবনের কথা আসে, তখন ঔদার্যও অনেক প্রয়োজনীয় একটি গুণ হতে পারে।
সত্যি এটাই যে, আপনার সবচেয়ে ভালো কর্মীর প্রয়োজন নেই, সবচেয়ে ভালো দলের দরকার। আজ আমরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হই, তা একা কাজ করা কোনো জিনিয়াসের পক্ষে সমাধান করা অনেক বেশি জটিল। এজন্যই শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবকেরা জ্ঞান ছড়িয়ে দেন, তারা নিজেদেরকে একটি নেটওয়ার্কের মধ্যে স্থাপন করেন যাতে করে তারা নিজেদের ও অপরের অন্তর্দৃষ্টির মূল্যবান অংশগুলোকে যেকোনো কঠিন সমস্যা সমাধানে কাজে লাগাতে পারেন।
তাই শেষ যে জিনিসটি আপনার দরকার হবে তা হলো নিয়মগত ‘উদ্ভাবক’ ব্যক্তিত্ব যা কিনা সকল সীমানা ভেদ করে লাখো আইডিয়া দিতে পারে। আপনার দরকার পড়বে এমন কিছু লোকের যারা কিনা সহযোগিতামূলক কাজ করতে পারে, অন্যের কথা মন দিয়ে শুনতে পারে এবং শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারে। আপনার প্রতিষ্ঠানে আগে থেকেই যদি এমন মানুষ থাকে তাহলে তা একটি অসাধারণ ব্যাপার, শুধু তাদেরকে হারিয়ে যেতে দেবেন না।
গ্রেগ শ্যাটেল রচিত, যিনি একজন জনপ্রিয় বক্তা এবং কনসাল্টেন্ট।
মূল লেখাটি www.hbr.org প্রকাশ পেয়েছে।
মন্তব্য করুন