চাপ থাকা সত্ত্বেও আপনি কিভাবে ‘না’ বলবেন

Share

বহু বছর ধরে আমি এমন একজন মানুষ ছিলাম যে লোক খুশি করাতে পছন্দ করে। এমন একজন, যে কিনা যেকোনো প্রয়োজনে হাসিমুখে নিজের সময় বের করে এগিয়ে আসবে। এবং পুরো শিক্ষা জীবনেই আমি এ দায়িত্বটি আনন্দের সাথে পালন করে গেছি। কারণ আমার একটা আশঙ্কা ছিলো যে, আমার কাছ থেকে ‘না’ শুনলে বন্ধু কিংবা প্রিয় মানুষেরা কষ্ট পাবে।

কিন্তু একসময় মনে হলো- আমি নিজের মতো করে আমার জীবন যাপন করছি না। তার বদলে আমি অন্যদের চাওয়া-পাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে একটা অগোছালো কর্মপরিকল্পনা মেনে চলছি- যার মাঝে কিছু আমি করতে চাইতাম, কিছু ভাবতাম করা উচিৎ। ফলাফল? একটা কঠিন সময়সূচী, যা আমাকে আরো অগোছালো করে দিচ্ছিলো।

এরপর অনেক দিন পেরিয়ে আমি ‘না’ বলাটা শিখতে পেরেছি। ‘না’ বলা মানে আমি সবার চাওয়া পূরণ করতে বাধ্য নই এবং আমি যা করতে চাই তার জন্য আরো বেশি সময় বের করতে পারা। সবকিছু করার চেয়ে আমি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করলাম। আমার প্রয়োজন ও আগ্রহের উপর ভিত্তি করে আমি সময় বন্টন করতে লাগলাম, যা আমাকে আগের চেয়ে আরো বেশি সুখী করলো। এবং অনুমান করুন? আমি তেমন কাউকে আশাহত করিনি।

সফল মানুষেরানাবলতে ভয় পান না

যদি আপনি ‘না’ বলার শিল্পটা ঠিকঠাক ধরতে পারেন, পুরো পৃথিবীর চেহারাই পালটে যাবে আপনার কাছে। যা কিছু করা যায় বা করা উচিৎ- সেগুলো দেখার বদলে আপনার চোখে পড়বে সেসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, যেগুলোকে আপনি ‘হ্যাঁ’ বলতে পারেন।

অন্যকথায়- জীবন আপনাকে যা দেবে সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকার পরিবর্তে আপনি সেসব সুযোগের প্রতি আন্তরিক হবেন, যারা আপনি যেখানে যেতে চান সেখানে পৌঁছাতে আপনাকে সাহায্য করবে।

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সফল নারী অপরাহ উইনফ্রে স্বীকার করেন যে, ‘না’ বলাটা শিখতে তার জীবনের অনেকটা সময় চলে গেছে। এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত হওয়ার পরও তিনি ভাবতেন- তাকে মোটামুটি সবকিছুতে ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে। একমাত্র তখনই তিনি তার ‘না’ বলতে না পারার সমস্যাটা কাটিয়ে উঠতে পারলেন যখন তিনি বুঝলেন, ‘আমি প্রশ্নটা ধরতে পেরেছি- আমি আসলে কি চাই?’

ওয়ারেন বাফেট তার সফলতার পেছনে ‘না’ বলতে পারার অবদানকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তিনি বলেন, ‘সফল ও আসলেই সফল মানুষদের মধ্যকার মূল পার্থক্য হচ্ছে- যারা আসলেই সফল তারা প্রায় সবকিছুতে না বলে।’

যখন আমি ‘না’ কে একটা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করি, অল্প সংখ্যক বিষয়ের উপর আরো অধিক মনোযোগ দিয়ে আমি আমার সাফল্যের দিকে আরো ভালোভাবে এগিয়ে যেতে থাকি।

কিভাবে আমরাহ্যাঁবলার চাপবোধ করি

এটা আশ্চর্যের কিছু না যে, আমাদের অধিকাংশেরই ‘না’ বলতে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়।

ছোটবেলা থেকেই আমাদেরকে ‘হ্যাঁ’ বলার অভ্যাস করানো হয়। স্কুল পাশ করে কলেজে ঢুকতে ঢুকতে আমাদের প্রায় শ’খানেকবার ‘হ্যাঁ’ বলতে হয়। চাকরি পাওয়ার জন্য ‘হ্যাঁ’ বলতে হয়। ‘হ্যাঁ’ বলতে হয় পদোন্নতির জন্য, ভালোবাসা খুঁজে পেতে ও টিকিয়ে রাখার জন্য। এমনকি বন্ধুদের মন রেখে চলতেও ‘হ্যাঁ’ বলতে হয় আমাদের।

আমরা ‘হ্যাঁ’ বলি কারণ কাউকে সাহায্য করাটা সবসময়ই আনন্দের। তাছাড়া আমরা হ্যাঁ বলি কারণ এটা মনে হয় যে, এটাই করার জন্য সঠিক কাজ। আমরা সাফল্যের চাবিকাঠি ভেবেও নানা সময় ‘হ্যাঁ’ বলে থাকি। তাছাড়া কর্তা ধরণের কারো কাছ থেকে অনুরোধ এলে তাকে মানা করতে বাধে বলে আমাদের ‘হ্যাঁ’ বলতে হয়।

এবং এখানেই শেষ না। ‘হ্যাঁ’ বলার এই চাপ মোটেও অন্যদের থেকে আসে না। আমরা নিজেরাই নিজেদের ওপর এটা তৈরী করি। কাজের ক্ষেত্রে, আমরা ‘হ্যাঁ’ বলি কারণ আমরা ভাবি যে অন্যরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করে ফেলছে। কাজের বাইরে, বন্ধু ও পরিবারকে আমরা যথেষ্ট সময় দিচ্ছি না- এমন অপরাধবোধে ভুগে আমরা ‘হ্যাঁ’ বলি।

তাই বার্তাটি যেখান থেকেই আসুক না কেন, আমরা নিজেরা ভাবি- ‘তুমি আরো অনেক বেশি কিছু করতে পারো।’ ফলাফল? যখন কেউ আমাদের কাছে সময় চায়, আমরা ‘না’ বলতে পারি না।

চাপে পড়েও কিভাবেনাবলবেন

আপনার জীবনে ‘না’ বলতে পারার গুরুত্ব মোটেও কম নয়। হয়ত আপনি ‘না’ বলেছেন, কিন্তু খুব একটা স্বস্তিবোধ করছেন না। সম্ভবত আপনার একটা আবছা ধারণা হয়েছে- ‘না’ বলার মাধ্যমে নিজের কাজের প্রতি আরো মনোযোগী হওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু এটাই সত্যি যে, অধিকাংশ মানুষই সহজে ‘না’ বলতে পারেন না।

‘না’ বলতে পারার ক্ষমতা আপনার জীবনে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। কিছু কিছু জিনিসকে ‘না’ বলা মানে আরো অনেক ভালো বিষয়ের জন্য আপনি দরজা খুলে দিলেন। এখানে ‘না’ বলার শিল্পটা শেখার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হলো-

) নিজের দায়িত্বটুকু সম্পর্কে সচেতন হন

‘না’ বলতে পারার পেছনে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে- দায়িত্ববোধ। আপনি মনে করেন ‘হ্যাঁ’ বলাটা আপনার দায়িত্ব এবং ‘না’ বলাটা আপনার উপর খারাপ প্রভাব ফেলবে?

) সবসময় গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিস করার ভীতিকে প্রতিহত করুন

আপনার কি গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিস করার ভীতি রয়েছে? এই উদ্বিগ্নতা জীবনে আমাদের নানাভাবে অনুসরণ করতে পারে। কাজের বেলায়, পিছিয়ে পড়ার ভয়ে আমরা স্বেচ্ছায় আমাদের অতিরিক্ত সময় দিই। এমনকি ব্যক্তিগত জীবনে, এই ভীতির কারণে নিজেরা আনন্দ না পেলেও আমরা আর সবার সাথে যোগ দিতে সম্মত হই।

নিজের সাথে মিলিয়ে দেখুন। আপনি কি কিছু মিস করে ফেলার ভয়ে ‘হ্যাঁ’ বলছেন? নাকি আসলেই চাইছেন বলে? অধিকাংশ সময়ই ভীতির পেছনে ছোটাটা আমাদের ভালোবোধ করাতে পারে না।

) ‘নাবলার অর্থ সম্পর্কে আপনার ধারণাটা পরখ করে নিন

আপনি কি ‘না’ বলার পরে পাওয়া প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভীত? অধিকাংশ সময়ই আমরা ‘হ্যাঁ’ বলি কারণ আমরা ‘না’ বললে অন্যরা ব্যাপারটিকে কিভাবে নেবে সেটা সম্পর্কে বেশি উদ্বিগ্ন থাকি। আমরা ভাবি আমরা তাদের আশাহত করবো বা তাদের ভালোবাসা হারাবো। কিন্তু আমরা নিজেদের কথাই ভুলে যাই- কিভাবে নিজেদের আশাহত করছি।

মনে রাখবেন- ‘না’ বলাটাই হতে পারে সেই বার্তা যার মাধ্যমে আপনি জানাতে পারেন যে, আপনার হাতে পর্যাপ্ত সময় নেই। নিচের একটা কৌশলে আপনারা দেখতে পাবেন, কিভাবে নরম ও সুন্দরভাবে ‘না’ বলতে হয়। আপনি হয়ত কাউকে কাউকে শুরুতে আশাহত করবেন, কিন্তু শুধুমাত্র একটা সীমানারেখা আঁকার মাধ্যমেই আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা পেতে পারেন।

) যখন কোনো অনুরোধ আসবে, বসে পড়ুন

মাঝে মাঝে যখন আমাদের কাছে অনুরোধ আসে, আমরা তাৎক্ষণিকভাবে রাজী হয়ে যাই। হয়ত অনুরোধটি শুরুতে ভালোই মনে হয়, বা আমরা অতীতে এমন অনুরোধে রাজীও হয়েছিলাম। তবু কাজটা আপনি ভালোভাবে করতে পারবেন কিনা সেটা বুঝতে নিজেকে কিছুটা সময় দিন। হয়ত আপনি সবচেয়ে ভালো উত্তরটা- ‘না’ দেবেন। নিজেকে সিদ্ধান্ত নিতে সময় দেয়াতে কোনো ক্ষতি নেই।

) স্বচ্ছতা ও উদারতার সাথেনাবলুন

যখন আপনি কাউকে ‘না’ বলতে প্রস্তুত, পরিষ্কারভাবে তাকে নিজের সিদ্ধান্তটি জানান। উত্তরটি খোলামেলা ও সৎ হওয়া উচিৎ যেন সে আপনার সীমিত সময়ের ব্যাপারটি বুঝতে পারে। উত্তর না দেবার অভ্যাসকে মোটেও প্রশ্রয় দেবেন না। আবার ‘না’ বলার খুব বেশি দীর্ঘ কারণ দর্শানোরও দায়বোধ করবেন না। ছোট ব্যাখ্যাসহ একটি পরিষ্কার বার্তাই হতে পারে সমাধান। আমার অনেক ধরণের কাজ থাকে ও আমি নিজের সময়কে যত্ন সহকারে ভাগ করি- মানুষকে এটা বলাটা আমার কাছে সবসময়ই দরকারি মনে হয়েছে। সেইসাথে তাদেরকে আমি এটাও বলি যে, তারা জিজ্ঞেস করাতে আমি খুব খুশি হয়েছি ও ভবিষ্যতে এমন সুযোগ এলে তারা যেন আবারও আমাকে জানায়।

) পরিবর্তিতনাব্যবহার করুন

যদি ‘হ্যাঁ’ বলার জন্য চাপে থাকেন কিন্তু ‘না বলতে চান, তাহলে ‘হ্যাঁ’-র বদলে ‘হ্যাঁ, কিন্তু…’ আপনাকে নিজের সম্মতির বিপরীতে কিছু শর্ত যুক্ত করার সুযোগ দেয়। কখনো এই শর্ত হতে পারে ঐ সময়ের কিছুটা পরে কাজটা করা বা আংশিক করা।

নাবলা শেখার সময় যা কিছু মনে রাখা জরুরি

আপনাকে আপনার স্বস্তির জায়গা থেকে বের হতে হবে

চলুন সত্য কথাটার মুখোমুখি হওয়া যাক- ‘না’ বলাটা বেশ কঠিন একটা কাজ। নিজের সময়ের চারিদিকে সীমানা দেয়াটা আপনার কাছে অস্বস্তিকর ঠেকতে পারে, যেহেতু আপনি আগে কখনো এটা করেননি।

আপনিই আপনার সময়ের নিয়ন্ত্রক

মনে রাখবেন- আপনিই হলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি আপনার সময়ের চাহিদা সম্পর্কে পুরোপুরি জানেন। এটা নিয়ে ভাবুন। আপনি ছাড়া আর কে আপনার সময়ের সব খুঁটিনাটি বিষয়ে জানেন? আর কেউ না। শুধুমাত্র আপনিই এসব অনুরোধের ঠিক মধ্যখানে আছেন। এবং একমাত্র ব্যক্তি যিনি আপনার সময়ের ব্যাপারে জানেন।

নাবলা মানে আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছুকেহ্যাঁবলা

যখন আমরা কোনো কিছুকে ‘না’ বলার সিদ্ধান্ত নিই, তার মানে আমরা আরো ভালো কিছুকে ‘হ্যাঁ’ বলতে পারি। আপনি আপনার মূল্যবান সময় ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেয়ার একটি অনন্য সুযোগ পেয়েছেন।

এখন থেকেইনাবলা শুরু করুন

আপনার হারানোর কিইবা আছে? এখন থেকেই শুরু করুন- আপনি অনুরোধের ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত নেয়ার ভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারবেন। যখন কোনো অনুরোধ আসবে, যেখানে আপনি সাধারণত ‘হ্যাঁ’ বলেন সেখানে নিজেকে অটোপাইলটের আসন থেকে সরিয়ে নিন। এটাকে নতুন একটা অনুরোধ হিসেবে বিবেচনা করুন যেখানে আপনি আপনার সময়ের চারিদিকে একটা চমৎকার সীমানা গড়তে চলেছেন। কখন আপনি নিজের উপর চাহিদা আরোপ করবেন সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিন। যখন নিজের ওপর চাহিদা আরোপ করবেন, বোঝার চেষ্টা করবেন যে- এটা কি আপনিই চাইছেন, না অন্য কোথাও থেকে আসছে।

এখন থেকেই চেষ্টা করুন। সেই বন্ধুকে ‘না’ বলুন, যে কিনা আপনার সরলতার সুযোগে সুবিধা নিচ্ছে। কিংবা কাজপাগল সেই সহকর্মীকে বলুন যে, আপনি অবশ্যই প্রজেক্টটি সম্পন্ন করবেন, কিন্তু তার জন্য ছুটির দিনে কাজ করতে রাজী নন। অথবা পরিবারের সেই সদস্যকে বলুন, আপনি তাকে টাকা ধার দিতে পারবেন না কারণ সে আগেরবারের ঋণই এখনো শোধ করেনি। আপনি নিজেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি সুখী হিসেবে আবিষ্কার করবেন।

লিখেছেন ড্যানিয়েল ডরোইশচ।
www.lifehack.com  সাইটে পূর্বপ্রকাশিত।

আপনি উদ্যমী!
আপনার জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চান?  

তাড়াতাড়ি সাবস্ক্রাইব করুন।

আমাদের সেরা কনটেন্ট আপনার ইমেইলে পৌছে যাবে প্রতি সপ্তাহে।  

Invalid email address
আপনি যেকোনো সময় আনসাবস্ক্রাইব করতে পারবেন।  

মন্তব্য করুন